ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

মতামত

ভিন্নমতে ছাত্রলীগের ভীতি!

ভিন্নমতে ছাত্রলীগের ভীতি!

ভিন্নমত দেখলেই হামলা ছাত্রলীগের

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ০২:০৭ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ০৪:১৭

সমকালে বুধবার 'ভিন্নমত দেখলেই হামলা ছাত্রলীগের, দর্শক প্রশাসন' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ব্যতীত সব ছাত্র সংগঠনের অধিকার সংকুচিত করছে তারা। ছাত্রলীগ চাইলে পুলিশ প্রহরায় প্রতিবাদ সভা করতে পারে। ইচ্ছে হলে মধ্যদুপুর কি মধ্যরাত যে কাউকে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দিতে পারে। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নেই স্বস্তিতে। আবাসিক হলে থাকতে হলে প্রথম শর্তই থাকে ছাত্রলীগের নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া। চলতি বছরের শুরু থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত ঢাবি ক্যাম্পাসে অন্তত ৯টি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে কাওয়ালি গানের আসর বসিয়েছিলেন একদল শিক্ষার্থী। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সেখানে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৯ এপ্রিল কথা কাটাকাটির জেরে ছাত্রলীগ নেতার 'নির্দেশে' হামলার শিকার হয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রাকিবুল হাসান প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। ২২ মে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির কয়েক নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এর দুই দিন পর এই হামলার ঘটনার প্রতিবাদ ও জুয়েলের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে ঢাবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে যাওয়ার পথে তাদের ওপর ফের হামলা করে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা, কর্মচারীকে মারধর, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ভাঙচুর ও ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার অভিযোগে করা এই মামলায় ৪০০ জনকে অচেনা আসামি করা হয়। সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিচার এবং আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার দাবিতে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর গত ৬ জুনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৯ আগস্ট দুপুরে ক্যাম্পাসের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির সামনের ফুটপাতে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখার তিন নেতা মারধরের শিকার হন। মারধরের জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাবি উপাচার্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে ফুল ও মিষ্টি নিয়ে তাঁর কার্যালয়ে যাওয়ার পথে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগ। হামলায় ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম, সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। সবশেষ গত ৭ অক্টোবর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার তিন বছরপূর্তি উপলক্ষে স্মরণসভা আয়োজন করে ছাত্র অধিকার পরিষদ। সেখানে আয়োজকদের ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস-ছাড়া করে ছাত্রলীগ। হামলায় পরিষদের অন্তত ১৫ নেতাকর্মী আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানে গিয়েও তাঁদের পেটায় ছাত্রলীগ। বিকেলে মেডিকেল থেকে পরিষদের অন্তত ২০ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই নেতার করা দুটি মামলায় পরিষদের ২৫ নেতাকর্মী ও অচেনা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

প্রতিটি ঘটনা বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়েও উল্টো মামলার ঘানি টানতে হয় প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর। এটা সম্ভব হয় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এই অন্যায় সুবিধা পেয়ে আসছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অভিভাবক উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা নিশ্চিতে রয়েছেন প্রক্টর। কিন্তু এসব ঘটনায় উপাচার্য এবং প্রক্টরের দলীয় সরকারের প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের ফলে কোনো সুফল পাওয়া যায় না। উল্টো ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ সংগঠনকেই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। 

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। শিক্ষাঙ্গনে নানা রকম সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাচ্ছেন। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং অপরাপর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ছাত্রলীগ এখন যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে নিজেদের প্রতিপক্ষ অপর ছাত্রকে আঘাত করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না, তা ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ আরও ঝুঁকিপূর্ণ করবে। ইতিহাস কখনও আড়াল করা যায় না। এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এনএসএফের প্রচণ্ড দাপট ছিল। তাদের ভয়ে ক্যাম্পাসে কেউ মুখ খুলত না। কিন্তু এখন সেই ছাত্র সংগঠনের নাম কেউ নেতিবাচক উদাহরণ ব্যতীরেকে উচ্চারণ করে না। বর্তমান ছাত্রলীগের রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস, সেই জায়গায় এখনকার ছাত্রলীগের সঙ্গে তা কোনোভাবেই মেলানো যায় না। নিজেদের দল ক্ষমতায় থাকার সুবিধা নিয়ে এই সংগঠনটি এখন যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তা দুঃখজনক। সংগঠনটির বিগত চার মেয়াদের শীর্ষ নেতাদের দিকে তাকালে এই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন নয় যে, ছাত্রলীগ এখন যেন আওয়ামী লীগের একটি লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা যেভাবে চাঁদাবাজি, হলের সিট ভাড়া, পদ বাণিজ্য, ঠিকাদারের সঙ্গে বিবাদ থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করতে না পারার মনোভাব দেখিয়ে চলেছেন তাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন কিছু নয়। ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার পরিবর্তে ভিন্নমত দমনে যেভাবে ছাত্রলীগ নেমেছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×