অন্যদৃষ্টি
কোহিনুর তুমি কার
সুধীর সাহা
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
ব্রিটেনের দ্বিতীয় এলিজাবেথের রানী হওয়ার গল্প অনেকটাই রূপকথার কাহিনির মতো। ১৯৫২ সালে স্বামী ফিলিপের সঙ্গে কেনিয়ায় রাজকুমারী এলিজাবেথ ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় তাঁর পিতৃবিয়োগ অর্থাৎ রাজার মৃত্যু সংবাদ আসে। কিছু বোঝার আগেই ব্রিটেনের রানীর মুকুট তাঁর করতলগত হয়। একের পর এক প্রথা বা রিচুয়ালের নামে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে মনে করিয়ে দিতেন রাজরক্তের শ্রেষ্ঠতা। মনে করিয়ে দিতেন, রাজপরিবার খানিকটা ওপরে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে রানীর মুকুট কিংবা সিংহাসনের কোনো মূল্য ছিল না। কিন্তু সেই মূল্যহীন মুকুটের গৌরব প্রচারেও ব্রিটেন, রানী এবং তাঁর পরিবার সবসময়ই ছিলেন তৎপর। রাজপরিবারের বিপুল সম্পত্তির উৎস কী- তা জানার অধিকার হয়নি কখনও ব্রিটেন কিংবা পৃথিবীর মানুষদের। রানী নানা রক্ষাকবচ তৈরি করে রাজপরিবারের আর্থিক তথ্য গোপন রেখেছেন।
দিল্লি শহরকে কচুকাটা করেছিলেন নাদির শাহ। ১৭৩৯ সালের প্রখর গ্রীষ্ফ্মে নাদির শাহ ফিরে গিয়েছিলেন পারস্যে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধনরত্ন। এসব নিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট ও ১২ হাজার ঘোড়া। সোনাদানা, মণিমুক্তা ছাড়াও লুট করা ওই ধনরত্নের মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর-সিংহাসনও। এ ময়ূর-সিংহাসনেই গাঁথা ছিল কোহিনুর হীরা আর লালরঙা তৈমুর রুবি। ভারতের অল্প্রেব্দর কোল্লর খনি থেকে আবিস্কারের পর কোহিনুর ছিল কাকোতীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে। ১৩১০ সালে কাকোতীয় বংশের সঙ্গে বরঙ্গলের যুদ্ধে এ কোহিনুর হীরা দখল করেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। এর পর খিলজিদের থেকে হাতবদল হয়ে কোহিনুরের আশ্রয় হয় মোগলদের কাছে। ১৫২৬-এর পানিপথের যুদ্ধেই কোহিনুর চলে যায় সম্রাট বাবরের হাতে। সেই কোহিনুর শাহজাহানের ময়ূর-সিংহাসনের চূড়ায় শোভা পায়। এর পর নাদির শাহের হাত ধরে কোহিনুর চলে যায় ইরানে। নাদির শাহের সাম্রাজ্যের পতনের পর কোহিনুর যায় আফগানিস্তানের আমির আহমদ শাহ দুররানির হাতে। ১৮১৩ সালে দুররানি পাঞ্জাবের সিংহাসন হারালে এ কোহিনুর আসে 'শের-ই-পাঞ্জাব' মহারাজা রঞ্জিত সিংহের হাতে। এর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাবে তাদের ঘাঁটি গাড়লে কোহিনুরের শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব থেকে কোহিনুর আশ্রয় পায় ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার রাজমুকুটে। সেই ইতিহাসের পথ ধরেই কোহিনুর বসানো মুকুটের মালিক হন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। উপনিবেশবাদের ইতিহাসের হাত গলে ভারতবাসী যে কথা কোনোদিনই ভুলতে পারেনি, তা হলো, কোহিনুর তাদেরই সম্পদ। ব্রিটিশরা মনে করে, কোহিনুর ভারত তাদের উপহার দিয়েছিল। আর ভারতবাসী মনে করে, কোহিনুর তাদের দেশ থেকে ব্রিটিশরা লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। প্রচার আছে, পাঞ্জাবের শাসক দিলীপ সিং ১৮৫০ সালে এ কোহিনুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কিন্তু প্রশ্ন সেখানেই। ১৮৫০ সালে দিলীপ সিং ছিলেন নাবালক। দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধের পর শিখদের হারিয়ে ব্রিটিশরা শিখ সাম্রাজ্য দখল করে। তার জন্য লর্ড ডালহৌসি লাহোরের শেষ চুক্তি তৈরি করেন। সেই লাহোর চুক্তির ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা ছিল- 'কোহিনুর হীরা মহারানীকে দেবেন দিলীপ সিং।' এ ছিল নাবালক রাজাকে কোহিনুর প্রদানে বাধ্য করার চুক্তি। সেই যুক্তিতেই ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় এবং এর পর ১৯৫৩ সালেও রানী এলিজাবেথের রাজ্য অভিষেকের সময় কোহিনুর ফেরানোর দাবি তুলেছিল ভারত। তখন চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তা খারিজ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ভারত সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন- কোহিনুর ফেরতের প্রশ্নে যদি হ্যাঁ বলতে হয়, তাহলে একদিন দেখা যাবে, গোটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামই ফাঁকা হয়ে গেছে।
ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরই ব্রিটিশদের বিভিন্ন দেশ থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া যাবতীয় ধনরত্ন ফেরতের দাবি উঠতে শুরু করেছে। এ ধনরত্নের মধ্যে রয়েছে ভারতের কোহিনুর হীরাও। ১০৮ দশমিক ৯৩ ক্যারাটের হীরাটি প্রথমে রানী ভিক্টোরিয়া তাঁর হাতে পরতেন। পরে তা স্থান পায় রানীর মুকুটে। সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে যেতে যে শুধু গুলি-বন্দুক নয়; একটা রূপকথাও প্রয়োজন- এটাই হয়তো রানী এলিজাবেথের সাত দশকের ঐতিহাসিক শিক্ষা ছিল।
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
ceo@ilcb.net
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- সুধীর সাহা