সমকালীন প্রসঙ্গ
সেনাশাসন নেই, দুর্যোগ থেকে গেল
মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, ততক্ষণে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। প্রাণ ও সম্পদহানির খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে।
মনে পড়ছে- বহু বছর আগে ১৯৮৯ সালে বার্লিনের একটি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনেই বিশাল একটি পোস্টার; জার্মান ভাষায় অনূদিত আমার নাটকের- 'ওরা কদম আলী'। পোস্টারটি কিছু জার্মান দেখছেন। এক ভদ্রলোক আমার গায়ের রং দেখে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, বলুন তো, এই দেশটি কোথায়? অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলাদেশের নামটা বললেন। আমি ভূগোলটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক চিনতে পারলেন এবং বললেন- হ্যাঁ, এই দেশে বন্যা হয় এবং মিলিটারি ডিক্টেটর আছে। বুঝলাম, মিডিয়ার বদৌলতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হয়েছে- বানভাসি ও স্বৈরাচারী দেশ।
এর পর ভদ্রলোক বললেন- তোমার দেশ কোথায়? আমি বললাম- বাংলাদেশ। এই যে নামটি দেখতে পাচ্ছ, যাঁর লেখা নাটক, আমিই সেই লোক। তিনি এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন- দুঃখিত। আমার ধারণা ছিল, এটি একটি পানিতে ডোবা দেশ এবং সেখানে সবসময় সামরিক স্বৈরশাসন চলে। সেখানে থিয়েটার হয়? আমি মোটামুটি ধারণা দিলাম এবং তিনি বললেন, থিয়েটারটি দেখতে আসবেন। ভদ্রলোক ঠিকই এলেন; জার্মান ভাষায় অনুদিত একটি বই কিনে আমার জন্য লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলেন। দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। একসঙ্গে কফি ও ধূম্র পান করতে করতে অনেক কথা হলো। এর মধ্যে নাট্যকার সাঈদ আহমদ যুক্ত হলেন। তিনি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে আরও তথ্য দিলেন।
আসলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে সুসংবাদ ততটা যায় না; ঢের বেশি যায় দুঃসংবাদ। মিডিয়ায় সাধারণত তা-ই হয়। সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদই গুরুত্ব পায়। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্যোগ সংক্রান্ত সংবাদ যেন নিত্যনৈমিত্তিক।
সিত্রাংয়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বোঝা যায়, আমাদের দেশটি অনেক দিক থেকেই অরক্ষিত। ১৯৭০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। মানুষ, গবাদি পশু-পাখি, গাছপালা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এর মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সময়োপযোগী নয়। এসব দুর্যোগের ফলে দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের চাপ পড়ে। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের চেহারা সংবাদমাধ্যমে ফুটে ওঠে। কী ধৈর্য আমাদের! অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে, তার মধ্যে একটি ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য মানুষের সে কী চেষ্টা!
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় দেশে একটাই কাজ হয়েছে; সাইক্লোন শেল্টার। এ আশ্রয়কেন্দ্র সারাবছর অনাদর-অবহেলায় থাকে। দুর্যোগ এলেই মানুষ সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেও সুযোগ-সুবিধার অনেক অভাব। ফলে বিপদগ্রস্ত অনেকেই সেখানে যেতে চান না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘূর্ণিঝড় যখন লোকালয়ে আসে, তা সাধারণত দুর্বল হয়ে পড়ে; যদি পর্যাপ্ত গাছপালা থাকে। কিন্তু কিছু এলাকায় ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। এ কারণেও ঘূর্ণিঝড় অবাধে প্রবল গতি নিয়ে হামলে পড়ে জনপদে।
ঘূর্ণিঝড় সবসময়ই বঙ্গোপসাগরে জন্ম নিয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোয় আক্রমণ করে। তার আক্রমণের ক্ষেত্র চিহ্নিত। কিন্তু সেসব এলাকায় প্রতিরোধের জন্য যে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন ছিল; সেই ১৯৭০ সাল থেকে তা নেওয়া হয়নি।
সামরিক শাসনামলে এসব দুর্যোগ কখনও কখনও খুব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিত। কারণ বিদেশি সাহায্যের ওপর সরকারগুলো নির্ভর করত। দারিদ্র্য বিমোচনের শর্টকাট পন্থা খুঁজত তারা। পরবর্তী সময়ে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ধনাঢ্য ব্যক্তির সংখ্যা; কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি ও বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচার। আবার ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। আমরা ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় যেসব চেহারা দেখি, তা একেবারেই দরিদ্র মানুষের। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে যে চেহারা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সেই চেহারাই বারবার দেখি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানোর কোনো উপায় নেই- পৃথিবীর সব দেশেই তা সত্য। তবে মানুষকে প্রস্তুত করা যেতে পারে। প্রস্তুত করার একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে এসব মানুষকে সক্ষম করে তোলা। অর্থনৈতিক সক্ষমতা মানুষকে অনেক বিকল্প দেয়। সেই বিকল্পের সন্ধানে মানুষ আরও বিত্তবান হতে পারে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অনেক দেশ প্রতিকূল আবহাওয়া, বছরের অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি সময় তীব্র শীত ও বরফের মধ্যে কাটিয়েও প্রভূত উন্নতি করেছে।
যেমন জাপানে ভূমিকম্প একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার মধ্যেও জীবন ও উন্নয়ন কোনোটাই থেমে থাকে না। সেখানে প্রায়ই ভূমিকম্পে কোথাও কোথাও রেললাইন ধ্বংস হয়ে যায়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবার রেললাইন মেরামত করে পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক দুর্বলতার ফলে কোনো ব্যবস্থাই কার্যকরী হয় না। খোদ ঢাকা শহরে ঝড়ে একটি গাছ পড়ে গেলে তা সরাতেও অনেক সময় লেগে যায়।
যখনই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তখনই কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু সেই তৎপরতা যে দীর্ঘ সময় চলে না, তার প্রমাণ হচ্ছে সাতক্ষীরা অঞ্চলের একটি বাঁধ, যা হাজার হাজার মানুষের জীবনে হুমকিস্বরূপ। বাঁধ মেরামতের সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
এসব অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা থাকেন রাজধানীতে অথবা কোনো বড় শহরে। সরকারি কর্মকর্তারা এলাকায় থাকলেও সুবেদারের জীবন যাপন করেন। জনপ্রতিনিধি ও আমলারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে চা-কফি খেয়ে নিজের সৃজনশীলতাকে ড্রয়ারে রেখে বিদেশি উপদেষ্টাদের কথা গলাধঃকরণ করেন। কমিশন ভাগাভাগি করে মন্থর গতিতে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভান করেন। কখনোই উপদ্রুত এলাকার কোনো প্রবীণ মানুষের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ওইসব প্রবীণের মধ্যেও প্রকৃতিবিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা হয়তো নিরক্ষর। প্রবীণদের মধ্যে আবহাওয়াবিজ্ঞানীও আছেন, যাঁরা হাতের তালুতে পানি নিয়ে বলে দিতে পারেন, কখন ঝড় আসতে পারে।
একবার চীনের হোয়াংহো নদীর পাড়ে এক বৃদ্ধ দৌড়ে আবহাওয়া অফিসে গিয়ে বললেন- প্রবল প্লাবন আসছে; এক্ষুনি সবাইকে জানিয়ে দিন। নিরাপদে সরে যেতে বলুন। আবহাওয়া কর্মকর্তা বললেন, আমি তো যন্ত্রে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বৃদ্ধ আবারও জোর দিয়ে একই কথা বললেন। আবহাওয়ার কর্তা তাঁর কথা শুনলেন না। সত্যি সত্যি প্লাবন এলো। মানুষ, গবাদি পশুসহ প্রচুর সম্পদ ধ্বংস হলো। তখন সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কী করে এটা জানলেন? বৃদ্ধ বললেন, আমি দেখছিলাম পিঁপড়ের সারি ক্রমে ওপরের দিকে যাচ্ছে। পিঁপড়ে প্লাবনের আভাস পায়। এটা তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই একটি জৈবিক ব্যবস্থা। মাও সেতুং বিষয়টি জানলেন এবং হোয়াংহো নদীপাড়ের মানুষদের নিয়েই চীনের দুঃখ বলে পরিচিত হোয়াংহো সমস্যা সমাধানে ব্রতী হলেন।
দেশের উন্নয়নে অভিজ্ঞ মানুষদের অংশগ্রহণ নেই এবং সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁরা তা মনেও করেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশনে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার একটা অবকাশ সৃষ্টি হয়েছিল। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের নিয়েই তৈরি হয়েছিল প্ল্যানিং কমিশন। কিন্তু বর্তমানে আমলারা তা দখল করে ফেলেছেন।
আজকে যদি জার্মান সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তিনি হয়তো বলবেন- তোমাদের দেশে সেনাশাসন নেই। কিন্তু প্লাবন ও দুর্যোগের অবসান তো হলো না!
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ
- মামুনুর রশীদ