প্রতিবেশী
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি

মঞ্জুরে খোদা
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০
হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এ উপমহাদেশের পিছু ছাড়েনি। ছায়ার মতো লেগে আছে। গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। গুলি তাঁর পায়ে লাগায় এ যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। পিস্তলধারী দুস্কৃতকারীর গুলিতে একজন প্রাণ হারায় এবং ১৪ জন আহত হয়। তবে ইমরান খানের বেঁচে যাওয়ার কারণ ইবতেসাম নামে এক যুবক। সে যুবক পিস্তলধারী দুস্কৃৃতকারীর শরীর জাপটে ধরায় ইমরান বেঁচে যান। তা না হলে হয়তো ভয়াবহ কিছু ঘটত।
১৯৫১ সালে রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যে ব্যক্তি তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল; পুলিশ সে খুনিকে হত্যা করে এর বিচারকে সেখানেই শেষ করে দেয়। ১৯৭৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সাজানো বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। এ কারণে জেনারেল জিয়াউল হককে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকও বিমান নাশকতার শিকার হয়ে মারা যান। ২০০৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হন। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। কিন্তু হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেমে থাকেনি।
ইমরান খান তাঁর ওপর হামলার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ে কর্মরত মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরকে দায়ী করেছেন। ইমরান খানের হত্যাচেষ্টার বিচার তো পরের কথা, তার মামলা নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মামলায় কাকে আসামি করা হবে-না হবে, তা নিয়ে এখনও রফা হয়নি। এই মামলা থেকে সেনা কর্মকর্তার নাম বাদ দিতে ইমরান খান অস্বীকৃতি জানানোয় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ইমরান খান নিজেই দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন, তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। এমনকি এ হত্যাচেষ্টার সংবাদ তিনি আগেই পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন। এখন প্রশ্ন- কারা তাঁর জীবন নাশ করতে চায়? রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে চায়? পাকিস্তানের রাজনীতিতে সে সমীকরণ বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়। সংগত কারণেই অতীতের ধারাবাহিকতায় বলা যায়, এর পরিণতিও ভিন্ন কিছু হবে না।
পাকিস্তানে কখনোই কোনো নির্বাচিত সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর অধিকাংশ সময় হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র ও তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসকরাই সেখানে ক্ষমতায় ছিলেন। আর ক্ষমতায় না থাকলেও নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, যা এখনও অব্যাহত।
এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংযোগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে আলাপ আরও জটিল ও জোরালো হয়ে উঠছে। এ বছর জুনে ইমরান খানের বিরুদ্ধে যখন অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়, তখন তিনি নিজেই এমন অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি প্রভাবশালী মহল (পাকিস্তান সামরিক বাহিনী) ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত (মার্কিন সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা) তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ রাজনীতিকের মুখ থেকে এমন অভিযোগ মার্কিনের জন্য মোটেই স্বস্তির নয়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- কেন তারা ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভূমিকা রাখল বা সমর্থন করল? ইমরানের সঙ্গে এক সময় সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক ছিল। তবে এতটা অবনতি হওয়ার কারণ কী? তাঁর ক্ষমতায়নে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্প্রতি ক্ষমতার নানা সমীকরণে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর ইমরান খান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের সঙ্গে ক্রেমলিনে সাক্ষাৎ এবং তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। এ ঘটনার পর ইউক্রেন প্রশ্নে ইমরান সরকারের ভূমিকা মার্কিন সরকারের পছন্দ হয়নি। উপরন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে কীভাবে বাণিজ্য করা যায়; ভারতের মতো কীভাবে অল্প দামে তেল কেনা যায়, সে বিষয় নিয়ে তিনি খোলামেলা মন্তব্য করেন। শুধু তাই নয়; এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিরও প্রশংসা করেন। কেননা, ভারত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া থেকে তেল ও খাদ্যপণ্য আমদানি করছে। এটি মার্কিন শাসক ও তাঁদের অনুগত পাকিস্তানের রাজনীতিকদের জন্য মোটেই স্বস্তির ছিল না।
একসময় চীন-আমেরিকার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা সমীকরণে কালক্রমে তা শিথিল হয়ে পড়ে। রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার যে ঐতিহাসিক বৈরিতা ছিল, সেই বরফ গলে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চীন-মার্কিন-পাকিস্তানের যে দীর্ঘ ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল; চীন-রাশিয়ার তৎপরতায় ইমরানকে ঘিরে তার ভিন্ন মেরুকরণ চলছে কি? এ ভাবনায় পাকিস্তানের মার্কিন বলয়ের তৎপর হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে তারা ইমরানকে আর নিরাপদ মনে করেনি। যে কারণে তাঁকে তুচ্ছ অজুহাতে বিদায় করা হলো।
এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) রাজপথ দখলের কৌশল গ্রহণ করে। সরকারের কাছে নির্বাচনের দাবি করে। সে দাবি করেই তারা বসে থাকেনি; নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আর সে কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থনও পায়। মাঠের অবস্থা বলে, ইমরান খান এখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি। পিটিআই আশা করে, এখন নির্বাচন হলে তাদের দল ফের ক্ষমতায় আসবে। পিটিআই বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। এ দলটি পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া ও গিলজিট-বাল্টিস্তানের প্রাদেশিক ক্ষমতায় আছে।
মার্কিনরা বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদ ও অনুগত নেতৃত্ব আশা করে। ইমরানও তা-ই ছিলেন। সেনা-ছাউনির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক তেমনই ছিল এবং তাঁর ক্ষমতায়নে তাঁকে সর্বতো সমর্থন দিয়েছে আমেরিকা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কিন্তু এখন তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলছেন, যা পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেমানান। পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ রাজনীতিক আজ পর্যন্ত তা করেননি। যে অবস্থা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই ভিন্ন বার্তা দেয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভাজন ও দ্বন্দ্বের কথা। তা হলো, ইমরান নিশ্চয়ই কোনো এক অংশের সমর্থন-ইন্ধন পাচ্ছেন। এতে পরিস্কার হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নয়া সমীকরণ ও সংযোগের ইঙ্গিত।
ইমরানের জনপ্রিয়তাই সামরিক বাহিনীর জন্য হুমকি তৈরি করেছে। যে সেনাবাহিনী রাজনীতিকদের হুমকি দিত, আঙুল তুলে কথা বলত; ইমরান এখন সেই কাজ করছেন। সামরিক বাহিনীর হয়তো ধারণা ছিল, ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসহায় হয়ে পড়বেন; দেশ ছেড়ে যাবেন। রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবেন। কিন্তু এর কোনোটিই হয়নি। বরং ব্যতিক্রম হয়েছে। এটাই পাকিস্তানের সেনাকেন্দ্রিক রাজনীতির হিসাবে গরমিল তৈরি করেছে। বাকিটা সময়ই বলবে, এর বোঝাপড়া কোন পথে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
- বিষয় :
- প্রতিবেশী
- মঞ্জুরে খোদা