প্রশ্নটা আন্তরিকতার

বেলারুশের মানবাধিকারকর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৫:১০
আমাদের দেশে পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে যেগুলির অবদান সর্বাধিক বলিয়া জনমানসে স্থান পাইয়াছে, তন্মধ্যে সমগ্র দেশে ছড়াইয়া-ছিটাইয়া থাকা ইটভাটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, অধিকাংশ ইটভাটায় পাইকারি হারে কাষ্ঠ জ্বালানো হয়। দেশের বনাঞ্চলের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাসের পশ্চাতে ইহার অবদান কিঞ্চিৎ নহে। দ্বিতীয়ত, ইষ্টক প্রস্তুতে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয় কৃষিজমির উপরস্থ মৃত্তিকা, যাহা ফসলের জন্য উর্বরাশক্তি জোগাইয়া থাকে- এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। তৃতীয়ত, ইটভাটা হইতে নির্গত ধোঁয়ায় বহু ধরনের রাসায়নিক বিদ্যমান, যেগুলির প্রভাবে ঐ সকল স্থাপনার ত্রিসীমানায় কোনো ফসল, বৃক্ষ তথা সবুজের অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখা দুরূহ। উপরন্তু এই সকল ক্ষতিকর ধোঁয়ার কারণে ইটভাটায় কর্মরত এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারীরাও বহুবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। এই প্রেক্ষাপটেই সরকার ২০১৩ সালে শক্তপোক্ত একটা ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করিলে অন্য সকল সচেতন মহলের মতো আমরাও সরকারকে সাধুবাদ জানাইয়াছিলাম। কিন্তু হতাশাজনকভাবে, ইতোমধ্যে প্রায় এক দশক অতিবাহিত হইলেও আইনটার বাস্তবায়ন প্রত্যাশামাফিক ঘটিতেছে না। অন্তত শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন উহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, টাঙ্গাইলে ১৪৮টা লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্রবিহীন ইটভাটায় কোনো প্রকার বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কাষ্ঠ জ্বালানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হইয়াছে। অথচ ২০১৩ সালের আইনে কোনো প্রকার কাষ্ঠ জ্বালানোর বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বহাল। শুধু তাহাই নহে, আইনে উল্লিখিত- কৃষিজমি ও সড়কের পার্শ্বস্থান, বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাইবে না। সেখানে উল্লিখিত প্রায় সকল ইটভাটার অবস্থান সড়ক, কৃষিজমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ-মন্দির ঘেঁষিয়া। আরও হতাশাজনক, এই সকল অবৈধ ইটভাটাকে সাত দিবসের মধ্যে বন্ধ করিয়া উহা তাহাদের জানাইতে হাইকোর্ট গত ৭ নভেম্বর অপর তিন জেলা প্রশাসন, তৎসহিত টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনকেও নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন, যাহা অদ্যাবধি মান্যতা পায় নাই।
প্রকৃতপক্ষে পরিবেশদূষণের এমন আয়োজন শুধু টাঙ্গাইল নহে, দেশের বহু অঞ্চলে বিদ্যমান। দেশে কতগুলি ইটভাটা সচল, উহার হিসাবই তো কোনো সরকারি দপ্তর দিতে পারিতেছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর বলিতেছে, সংখ্যাটা আট সহস্রের অধিক হইবে। পক্ষান্তরে পরিবেশবিদগণের মতে উহা দশ সহস্রের কম হইবে না। আর পরিবেশ অধিদপ্তর আড়াই সহস্রের মতো ইটভাটা তাহাদের নিকট হইতে পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া দাবি করিলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯০ শতাংশই ঐ ছাড়পত্রবিহীন। ২০১৩ সালের আইনে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটার কথা বলা হইয়াছে। উক্ত বিধানে আধুনিক প্রযুক্তি বলিতে জ্বালানিসাশ্রয়ী বিভিন্ন প্রযুক্তির উল্লেখ করা হইয়াছে। বাস্তবতা হইল, খুব স্বল্পসংখ্যক ইটভাটাই এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করিতেছে। আমরা জানি, ঐসব প্রযুক্তি ব্যয়বহুল বিধায় অনেক মালিকেরই সামর্থ্য নাই তাহা ব্যবহারের। ইহাও সত্য, মালিকগণ চাহিলে অন্যান্য শিল্পের মতো সরকারের নিকট সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তিতে দেনদরবার করিতে পারিত। কিন্তু ইহা লইয়া সরকার বা মালিক কোনো মহলেই আলোচনা দৃশ্যমান নহে, বাস্তবায়ন দূরস্থ। অভিযোগ, অবৈধ ইটভাটার মালিক এবং সংশ্নিষ্ট সরকারি দপ্তরসমূহের অসাধু কর্মীদের মধ্যে এক প্রকার অশুভ আঁতাত রহিয়াছে। তজ্জন্য পরিবেশবিধ্বংসী সনাতন ধারার ইটভাটাসমূহ এখনও স্বীয় কার্য চালাইতেছে।
আমরা মনে করি, এহেন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি চলিতে থাকিলে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের সমূহ সর্বনাশ ঘটিবে। তবে আশার কথা, সম্ভবত বিষয়টা অনুধাবন করিয়াই সরকার ২০১৯ সালে অপর আইন প্রণয়ন করিয়াছে, তথায় ২০২৫ সালের পর সকল প্রকার সরকারি কাজে ইষ্টক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার কথা বলা হইয়াছে। ২০১৯-এর নভেম্বরে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট অক্ষরে লিখিত- ২০২৫ সালের পর সরকারি নির্মাণকাজে ইষ্টকের পরিবর্তে বালি ও রাসায়নিকের সংমিশ্রণে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত ব্লক ব্যবহার করিতে হইবে, যথায় মৃত্তিকা কেন; অগ্নির কোনো সংশ্নেষই থাকিবে না। সরকারের হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবংবিধ পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী প্রস্তুতে ইতোমধ্যে সাফল্যও অর্জন করিয়াছে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার ২০১৩ সালের আইন, তৎসহিত এই আইনও কার্যকরে আন্তরিক ও সচেষ্ট হইবে।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়
- প্রশ্নটা আন্তরিকতার