মতামত
সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ এবং বিএনপির লাভ-ক্ষতি

সাইফুর রহমান তপন
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৬:২৬ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৬:৩১
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ছয় সংসদ সদস্য রোববার জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ইতোমধ্যে স্পিকার তাঁদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং তার পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করে গেজেট বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়েছে। নিয়ম অনুসারে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে আসনগুলোয় উপনির্বাচন হবে। জানা মতে, সেই প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটির ছয়জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; ছয়জনের বিপরীতে একটি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য পায় দলটি; সেই হিসাবে একাদশ সংসদে মোট সাতজন সদস্য ছিলেন বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং কয়েক দফায় দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করা বিএনপির। সাতজনেরই একসঙ্গে পদত্যাগ করার কথা ছিল; একজন বিদেশে অবস্থান করায় রোববার পদত্যাগ করতে পারেননি। তবে তিনি যে পদত্যাগ করবেন- এ বিষয়টা নিশ্চিত। কারণ সমকালের এক প্রতিবেদনে পদত্যাগকারী সংসদ সদস্যদের উদ্ৃব্দত করে যেমনটা বলা হয়েছে, বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তটা তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্ত।
বিএনপি এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমন পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল; বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৯ অক্টোবর দলের রংপুর বিভাগীয় সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন, তাঁদের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছেন। আর শেষ দিকে এসে 'অনেকটা সরকারের চাপে পড়ে' ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ বললেও বিএনপি নেতারা সেপ্টেম্বরে বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণাকালে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে মহাসমাবেশ হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, সারাদেশ থেকে তাদের কর্মী-সমর্থকরা এতে যোগ দেবেন এবং মহাসমাবেশে এমন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে; যার ফলে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির কয়েকজন নেতা ১০ ডিসেম্বরের পর দেশে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায় চলবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে কথাও স্মরণ করা যায়। মোট কথা, সরকারের জবরদস্তিমূলক আচরণ ও কৌশলের কারণে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত উত্তাপ তৈরিতে ব্যর্থ হলেও, এটিই যে 'অন্তত দলটির নেতাকর্মীদের কাছে' বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের মোক্ষম সময়, তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই।
এ কথা স্বীকার করতে হবে, সরকারের বিভিন্ন বাধা ডিঙিয়ে একে একে নয়টা বিভাগীয় সমাবেশ সফল করার মাধ্যমে বিএনপি শুধু মূলধারার সংবাদমাধ্যম বা সামাজিকমাধ্যম নয়, জনপরিসরেও বেশ আলোচনা ও কৌতূহল তৈরি করতে পেরেছিল; এতে প্রতিপক্ষ তথা শাসক মহলেও কিছুটা হলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছিল। সরকারের একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপির কর্মসূচিগুলো নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব প্রতিক্রিয়া আসছিল শুধু সেগুলো দেখলেই এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। তবে এটাও অনস্বীকার্য, নীতিনির্ধারকদের ভুল কৌশল বা অন্য যে কোনো কারণে ঢাকায় এসে বিএনপি সেই উত্তাপ ধরে রাখতে পারেনি। সেদিক থেকে আমার মনে হয়েছিল, বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগে আরও একটু সময় নেবেন। বিএনপি বলছে, ডান-বাম মিলিয়ে বহু বিরোধী দলকে তারা অচিরেই এক ছাতার নিচে না হোক অন্তত যুগপৎ আন্দোলনে নিয়ে আসবে; দুর্বল হলেও কিছু দল তাদের ডাকে ইতোমধ্যে সাড়াও দিয়েছে। দলটির নেতাদের বক্তব্য অনুসারে, এ আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা সরকারকে 'উৎখাত' করবেন; অর্থাৎ বিএনপির পক্ষে রাজপথে উত্তাপ তৈরির অবকাশ এখনও আছে। সে রকম পরিস্থিতিই হতে পারত দলটির সংসদ সদস্যদের সংসদ ত্যাগের মোক্ষম সময়।
কথাটা এ জন্য বলা হলো, বিষয়টা সরকারের জন্য তেমন বিব্রতকর না হলেও, বিরোধী শিবিরে বাড়তি টনিক তৈরির জন্য বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ। সেই টনিক সৃষ্টি হতে পারত সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাপ তৈরি হলে। তখন এ ধরনের একটা ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিসরেও আলোচনার জন্ম দিতে পারত। কিন্তু এখন এমন এক সময় যখন রাজপথের উত্তাপ তো দূর স্থান, বিএনপি শিবিরে চলছে বিগত কয়েক মাসের 'বিনিয়োগের' লাভ-ক্ষতির হিসাব। আন্দোলনের কিছুটা হলেও ভাটার সময়ে বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ আন্দোলনকেও উজ্জীবীত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
আসলে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে এর কোনো বিকল্প ছিল না। সমাবেশ থেকে যদি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের ঘোষণা না আসত তাহলে নয়াপল্টনে 'যে কোনো মূল্যে' সমাবেশ করা নিয়ে সরকারের উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ থেকে বিএনপির পিছু হটার বিষয়টি বেশি আলোচিত হতো; যা দলটির 'উজ্জীবিত' নেতাকর্মীদের জন্য এক ধরনের হতাশা বয়ে আনত। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিএনপি যে একটা বড় ট্রাম্প কার্ড ছোট উদ্দেশ্যে খেলে দিল, তা কি তারা বুঝতে পেরেছে?
আরেকটা বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ- গত কয়েক মাস দেশের সংবাদমাধ্যমে বলা যায়, বিএনপিই জায়গা পাচ্ছিল বেশি। এখানে সংবাদমাধ্যম বরাবরই রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে খোরাক পায়। বিশেষত গত এক দশকে নানা কারণে বিরাজনীতিকরণের ধারা প্রবল হওয়ায় সংবাদমাধ্যম সেই খোরাক থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এ অনাকাঙ্ক্ষিত অচলাবস্থা পরিবর্তনে বিএনপির সাম্প্রতিক গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে; তার ফল হিসেবেই তারা সংবাদমাধ্যমের এ মনোযোগ কেড়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদে সংখ্যায় কম হলেও বিএনপির সংসদ সদস্যরা যেভাবে তৎপর ছিলেন, তারও একটা বড় অবদান আছে বলে আমার মনে হয়। আমি বলতে চাচ্ছি, সরকারকে টক্কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি সংসদের বাইরে তো বটেই ভেতরেও ভালোই ভূমিকা রাখছিল। পদত্যাগের কারণে বিএনপি একটা ফ্রন্ট হারাল।
রাজপথের আন্দোলনকে গতি দিতে সংসদ থেকে দলীয় সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ দেশে এ প্রথমবার ঘটল তা নয়। এর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ সালে এ অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে সংঘটিত ওই গণপদত্যাগ লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিল। সম্ভবত সেই উদাহরণ থেকেই বিএনপি এবার একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সংসদের সব বিরোধী দল এক হয়ে আন্দোলন করছিল; সংসদ থেকে পদত্যাগেও তাদের সবাই '১৪৭ জন' একতা দেখিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের পদত্যাগ জনমনে যে ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছিল, সংখ্যার দিক থেকে তো নয়ই, পরিস্থিতি বিবেচনায়ও বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ তার ধারেকাছে যেতে পারেনি।
বিএনপি সংসদ সদস্যদের পদত্যাগে সরকারি দলের প্রাধান্যধীন বর্তমান প্রায় একতরফা সংসদ হয়তো জনগণের কাছে তার আকর্ষণ হারাবে, তবে বিএনপিও যে একই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে জনমনে সৃষ্ট সরকাবিরোধী ক্ষোভকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানোর একটা বেশ ধারালো অস্ত্র হারাল, তাও জোর দিয়েই বলা যায়।