ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০


ঢাকার বিদেশি দূতদের কড়া বার্তা দিয়েছে সরকার- এমন শিরোনামের খবর দেখা গেল সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের মন্তব্যে বাংলাদেশ সরকার এর আগেও অস্বস্তিতে পড়েছে। সোমবার সমকালে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বিদেশি কূটনীতিকদের শিষ্টাচার ভঙ্গের বিরুদ্ধে 'হুঁশিয়ারি' দিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত করবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন খবর পড়ে প্রথমেই মনে পড়ল যে বাক্যটি তা হলো- 'একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!' মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত 'বীরাঙ্গনা কাব্য'কে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে মনে করা হয়। বীরাঙ্গনা কাব্যের একটি অংশে রাম বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁরই প্রিয়ংবদা সীতার কথা শুনে। রাম আঁৎকে উঠে বলেছিলেন- 'একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে।' যদিও এখন আর সেই রামরাজত্ব নেই, তবে রাজদরবারের পুরোহিত, পণ্ডিত ও পুঙ্গবেরা এখনও আছেন, দেখতে পাই। রাম কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন, সেটি রামায়ণ যাঁরা পাঠ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয় জানেন। যাঁরা রামায়ণ পাঠ করেননি, তাঁদের জন্য সমকালে প্রকাশিত -'বিদেশি দূতদের কড়া বার্তা দিল সরকার' শিরোনামের খবরটি পড়লেও চলবে। আশা করি, আশ্চর্য হতে বেগ পেতে হবে না।
বাংলাদেশে বিদেশি শক্তির কথা নিয়ে প্রায়ই জোর আলোচনা হয়। এ আলোচনাটি নির্বাচন এলে আরও বেশি শোনা যায়। অন্তত গত দুই দশকের রাজনীতি ও নির্বাচনের দিকে তাকালে এর সত্যতা মিলবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলিসহ বিভিন্ন বিদেশি মিশনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে আগামীর বাংলাদেশের পথচলা নির্ধারিত হবে। আর এই পথেই মানবাধিকারের সুরক্ষা দেব আমরা। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের বিষয়ে বিশ্বাসী। অন্যরা আমাদের মানবাধিকারের মূল্যবোধের শিক্ষা দিলে তাতে অবাক হওয়ার কথাও বলেছেন এক মন্ত্রী। সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলকভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও দাবি করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয়, সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি ১৫টি মিশনের বিবৃতি আমাদের নজরে এসেছে। সেই বিবৃতিতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আমাদের দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও নীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
যে কোনো স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা না বলা অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। তবে অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে- এই বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে থাকে শুধু তখনই, যখন তাঁরা ক্ষমতায় থাকেন। যখনই তাঁরা বিরোধী দলে যান, তখন বেমালুম ভুলে যান। আবার যখনই প্রয়োজন হয়, অভিযোগ নিয়ে যান রাষ্ট্রদূতদের কাছে। অতীতে এমনও দেখা গেছে, বিদেশি কেউ এসে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও নিয়েছেন। এখন বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে বিষয়টিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রদূতরা চাইলে আমাদের দেশ নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন। কারণ তাঁরা জানেন এর জন্য তাঁদের কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না। অন্তত অতীতে তাই দেখা গেছে। এ ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেওয়া অনেক পশ্চিমা দেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই আমরা যদি নিজেদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা না দিতে পারি, তখন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবেন- এটা ধরে নিতে হবে।
এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×