ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

মানবাধিকার

দক্ষিণ এশিয়ায় এক ঝলক আলো

দক্ষিণ এশিয়ায় এক ঝলক আলো

ইয়মিনি মিসরা

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০

দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি একনজরে মনে হবে, এ অঞ্চলে মানবাধিকার সুদূরপরাহত এবং ন্যায়বিচারের পথ সহজ নয়। তারপরও এখানকার মানুষ যেহেতু মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, সেহেতু আশাবাদের সুযোগ আছে। ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তারপরও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু জায়গা তৈরি হয়েছে, সেগুলো স্বীকার করতেই হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয় মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং অন্য যে কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, তাদের ওপর। তবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য আমাদের সম্মিলিত লড়াইয়ের মাধ্যমে ওই ভুক্তভোগীদের কারও কারও জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পেরেছি।
শ্রীলঙ্কার কথা যদি বলি, সেখানে প্রশাসন সমালোচকদের ওপর ১৯৭৯ সাল থেকে 'প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্ট'-পিটিএ বা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ আইন ব্যবহার করছে। সেখানে বিনা বিচারে আটকাবস্থায় দুই বছর থাকার পর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একজন আইনজীবী হিজাজ হিজবুল্লাহ জামিন পেয়েছেন। তিনি সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন এবং তাঁকে পিটিএ আইন অনুসারে আটক করা হয়েছিল। সেখানে আগস্ট মাসে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমরান ছাড়া পান। তাঁকে একই আইনে অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছিল। এই ঘটনার মাসখানেক পর শ্রীলঙ্কায় তামিল ইউটিউব চ্যানেলের পরিচালক দিবানিয়া মুকুনথান ছাড়া পান।
ভারতে কর্তৃপক্ষ 'আন-লফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট' বা ইউএপিএ আইন ব্যবহার করে কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই মানবাধিকার কর্মীদের জেলে ভরছে। তবে সেখানে এ বছর অন্তত দুটি ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। কবি ও প্রগতিশীল চিন্তক বারবারা রাওকে ২০১৮ সালে ইউএপিএ আইনে আটক করা হয়েছিল; তিনি এ বছর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে জামিন পান। খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক আনন্দ তেলতুমদে একই আইনে ২০২০ সালে আটক হয়েছিলেন। তাঁকেও এ বছর জামিন দেওয়া হয়।
মে মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আরেকটি ইতিবাচক ঘটনা ঘটে। সেখানে দেশটির ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত করা হয়। এটি ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বড় পদক্ষেপ। আদালত সেখানে যৌনকর্মীদের সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন। এটাই প্রমাণ করছে- সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এসব দৃষ্টান্তে আমরা এই প্রত্যাশাও করতে পারি, আদালত মানবাধিকার সুরক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে যারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে তাদেরও আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করবেন।
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন শুধু ভারতেই নয়; এ অঞ্চলজুড়েই। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা চালানো হচ্ছে। ইতিবাচক বিষয় হলো, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ব্লাসফেমি মামলার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এটি যথেষ্ট নয়। এর বিলুপ্তিই সমাধান।
মালদ্বীপেও কঠোর ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। সেখানে অ্যাক্টিভিস্ট মোহাম্মদ রুস্তম মুজতবা সামাজিক মাধ্যমে ধর্মের সমালোচনা করে পোস্ট দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হন। এ বছরের আগস্টে তিনি ছাড়া পান।
বাংলাদেশে ফেসবুক পোস্টে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দেড় বছর ধরে সংশোধন কেন্দ্রে আটক ছিলেন কিশোরী দীপ্তি রানী দাস। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি জামিন পান।
দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর অধিকার সুরক্ষায়ও অগ্রগতি হয়েছে। নেপালে মানবাধিকার কর্মীরা সহিংসতার শিকার নারীর অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের আন্দোলন করছেন। তাঁদের প্রচারণার ফলে সরকার ধর্ষণ ও অন্য যৌন সহিংসতায় বিশেষ সময়সীমাকে এক বছরের পরিবর্তে তিন বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এই ছোট বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে।
আফগানিস্তানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। তালেবানের এক বছরের শাসনামলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরেও নিপীড়ন, অত্যাচার বেড়েছে। হাজারা সম্প্রদায় ও সাবেক সরকারসংশ্নিষ্টদের জোরপূর্বক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন এসে তালেবান ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। তালেবান কর্তৃক মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরায় আফগানিস্তানের খ্যাতিমান নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ফয়জুল্লাহ জালালকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্য মানবাধিকার কর্মীদের প্রাচরণার ফলে কয়েক মাস পরই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। আরেকটি ইতিবাচক ঘটনা ঘটে অক্টোবরে, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ঘোষণা করেন- আফগানিস্তানে সশস্ত্র সংঘাতের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টির অনুসন্ধান আবার শুরু হবে। যে কারণে দীর্ঘ প্রত্যাশিত কিছু ন্যায়বিচার বিষয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছে। যেখানে যেভাবে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেখানেই আশার আলো দেখছি আমরা। তবে নারীর জন্য সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশ এখন আফগানিস্তানে। সেখানে যে নারীই তাঁর অধিকারের জন্য লড়াই অব্যাহত রাখছেন, তিনিই নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
ভারতে বিলকিস বানুর দহন অনুধাবন করা কঠিন নয়, যিনি ২০০২ সালে দেশটিতে গুজরাট দাঙ্গার জন্য দায়ী এবং তাঁকে ধর্ষণকারীদের বিচারের জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখছেন। এই দহন বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী শাহনেওয়াজ চৌধুরীরও। তিনি পরিবেশদূষণ ও কয়লা প্রকল্পে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে জেল খেটেছেন। একই প্রকার দহন ফুটে উঠেছে শ্রীলঙ্কার আন্দোলনকারীদের দৃঢ়তার মধ্যে, যাঁরা তাঁদের দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের শক্তিশালী লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। তাই আসুন, তাঁদের সাধুবাদ জানাই এবং সবার জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করার লড়াইয়ে তাঁদের সহায়তা করি। মানবাধিকারের বাতি প্রজ্বলিত রাখার ব্যবস্থাটি যেন আমরা করি। কারণ আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, আশা হলো অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখা।
ইয়মিনি মিসরা: আঞ্চলিক পরিচালক, দক্ষিণ এশিয়া, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত, ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×