ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্রচিন্তা

মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্তৃত্ব

মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্তৃত্ব

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৬:১৬

বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে মেহনতি মানুষেরা। তাদের শ্রমেই রাষ্ট্রটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রে ওই মেহনতিদের দশাটি কেমন? দেড়শ বছর আগে হৃদয়বান মানুষেরা মন্তব্য করে গেছেন- এ দেশে শতকরা ৯৫ জন মানুষই বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দেড়শ বছরে কত কী ঘটল! কত রকমের বিপ্লবই না সংঘটিত হলো! কিন্তু ওই শতকরা ৯৫ জনের ভাগ্য আর ফিরল না। তারা কেবল বঞ্চনা নয়; শোষণেরও শিকার হয়ে রইল। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিলেন, তাঁরাও যথাযথ স্বীকৃতি পেলেন না।
আমাদের ওই যুদ্ধটা ছিল একটি জনযুদ্ধ। জনগণ লড়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। বিদ্রোহ করে তাঁরাও যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন; প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধকালে তাঁরা কেউই পেশাদার সৈনিক ছিলেন না; পরিণত হয়েছিলেন জনযোদ্ধাতে। যুদ্ধ শেষে হিড়িক পড়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট প্রদানের। অযোদ্ধা ও ভুয়া যোদ্ধারাও সার্টিফিকেট ও তদ্‌জনিত সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিল। সাধারণ যোদ্ধারা কে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ তার খোঁজ করল না।

বীরত্বের জন্য অনেক যোদ্ধাকেই পদক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই পদক তালিকায় প্রধানত রয়েছেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। সর্বোচ্চ পদক বীরশ্রেষ্ঠ- পেয়েছেন সাতজন। তাঁরা সবাই সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। ৬৮ জন বীরউত্তমের মধ্যে দু'জন ছাড়া সবাই সামরিক বাহিনীর। বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক হচ্ছে নিচের দুটি পদক। ওই প্রাপ্তিতে বেসামরিক যোদ্ধারাও কিছু সংখ্যায় আছেন, তবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিই অধিক। ১৭৫ জন বীরবিক্রমের মধ্যে ১৪৫ জনই সামরিক বাহিনীর। ৪২৬ জন বীরপ্রতীকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ৩০৫ জনই সামরিক বাহিনীর সদস্য।
সবচেয়ে বড় অন্যায় করা হয়েছে নারীদের প্রতি। তাঁরা দু'ভাবে উপেক্ষিত- প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত মেহনতি শ্রেণির মানুষ হিসেবে। তাঁদের এমনকি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথার্থ স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি। সম্মান জানানোর জন্য যাঁদের 'বীরাঙ্গনা' বলে আলাদা করা হয়েছে, সেটি প্রদানও পদবিপ্রাপ্তদের জন্য সম্মানের না হয়ে সামাজিক অসম্মানের কণ্টক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে যাঁদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বলা হয়েছে, তাঁদের জন্য ওই পদবি পর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়নি। যে জন্য এখন 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' বলার রেওয়াজ চালু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যেন যথেষ্ট পরিমাণে বীর ছিলেন না।
মস্ত বড় ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যারা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে তাদের হাতে। পাকিস্তানি হানাদাররা তো শুরু থেকেই বলে আসছিল, মুক্তিযোদ্ধারা আসলে ভারতের সাহায্যপ্রাপ্ত দুস্কৃতকারী ভিন্ন অন্য কিছু নয়। শেষদিকে তারা চেষ্টায় ছিল বাংলাদেশের জনযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দিতে। এ ব্যাপারে তাদের শত্রুপক্ষ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যে অসম্মতি ছিল, তাও নয়। ভারতীয় ইতিহাস লেখকদের অনেকেই যুদ্ধটাকে ওভাবেই চিহ্নিত করার চেষ্টা নিয়েছেন। তাঁদের লেখা পড়লে ধারণা জন্মে- মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীকে পথঘাট চিনিয়ে দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা দান করেছেন; এটা খুবই সত্য। কিন্তু যুদ্ধটা আসলে করেছে ভারতের নিয়মিত বাহিনীই। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান এমএজি ওসমানী যে উপস্থিত থাকতে পারলেন না, সে ঘটনাকে তাৎপর্যবিহীন মনে করার কোনো কারণ নেই।


মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারের ফলে পূর্ববাংলা একদিন স্বাধীন হয়ে যাবে- এমন কথা প্রকাশ্য জনসভায় তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেন। আগাগোড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। ছিলেন তিনি জনযুদ্ধের নায়ক। একাত্তরে তিনি ভারতে চলে যান; দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করবেন এই আশা নিয়ে। সেখান থেকে তিনি বিবৃতি প্রচার করেছেন; বিশ্বনেতাদের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভারতে গিয়ে তিনি মোটামুটি আটক অবস্থাতেই ছিলেন। স্বাধীনতার পরে দেখা গেছে তাঁকে ক্রমাগত ইতিহাসের বাইরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। ইতিহাস বিকৃতির এও এক প্রকৃষ্ট নজির বৈকি।
মওলানার বড় অপরাধ, তিনি মেহনতি মানুষের পক্ষে ছিলেন। সত্য এটা যে, এর বিপরীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন পুঁজিবাদী উন্নয়নে আস্থাশীল- কেউ কম কেউ
বেশি। অবস্থানের কারণে মওলানা ভাসানীকে না পছন্দ করেছে পাকিস্তানিরা, না ভারতীয়রা। অবিকল জনযুদ্ধের সৈনিকদের দশা।
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন বিষণ্ণতা। অনেকটা ঢাকা শহরের দূষিত বায়ুর মতোই এই বিষণ্ণতার স্থিতি। তার কারণ মেহনতি মানুষের মুক্তি আসেনি। শ্রমের যে মর্যাদার কথা বই-পুস্তকে পাওয়া যায়, সেটা সমাজ ও রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলে শ্রমের যে উৎপাদন শক্তি, তা অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে; মুক্ত হতে পারেনি। বিষণ্ণতা অবশ্য এখন বিশ্বজুড়ে। অনেক উন্নতি আমরা দেখলাম, কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমলো না। দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল; যুদ্ধ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই ঘটাল; অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিল। এখনও যুদ্ধ থামেনি। আঞ্চলিক যুদ্ধ চলছে এবং সেসব যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিপদে পড়ছে সারাবিশ্বের মানুষ। বিপদ কমেনি; বিষণ্ণতা কাটে কী করে!
ভারত আমাদের নিকটতম ও অতিঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। ওই রাষ্ট্রটিকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেখানেও যা চলছে, তাকে কেউ প্রকৃত গণতন্ত্র বলবে না। ভারতের হৃদয়বান মানুষেরাও তাকে গণতন্ত্র বলে না। সেখানে আসলে যা বিদ্যমান তা হচ্ছে, ভোটের সাহায্যে নির্বাচিত স্বৈরশাসন। এই স্বৈরতন্ত্র বহুজাতির দেশ ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টায় মেতেছে। ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তো অবশ্যই, গণতন্ত্রে বিশ্বাসীরাও প্রমাদ গুনছেন। ওদিকে আবার হিন্দুত্ব, হিন্দুস্তান ও হিন্দি ভাষা- এই তিনকে এক করে ফেলার চেষ্টারও কমতি নেই। ফলে অ-হিন্দি রাজ্যগুলোর হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও ভীষণভাবে বিপদগ্রস্ত এবং অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। 'দেশ' পত্রিকাটি এক সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সপ্তাহে সপ্তাহে বের হতো; ধাক্কা খেয়ে সেটি এখন পাক্ষিক হয়েছে। দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যাটি বিখ্যাত ছিল তার সাহিত্য সম্ভারের জন্য। এবারের পূজা সংখ্যাটি কিন্তু দেখলাম অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। গল্প, উপন্যাস, কবিতা- এসব আছে। কিন্তু বড়ই কোণঠাসা অবস্থায়। জয়জয়কার বলদর্পী বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপনই যেন আসল; বিজ্ঞাপনের প্রচারই লক্ষ্য। সাহিত্য হচ্ছে উপলক্ষ; বিজ্ঞাপন ছাপার উপায় ও অজুহাত।
সমস্ত সংখ্যায় পরিব্যাপ্ত একটি বিষণ্ণতা। শুরুতেই সম্পাদকীয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- 'শিল্পোদ্যোগে বাঙালি সর্বভারতীয় স্তরে বা বিশ্বপর্যায়ে পিছিয়ে, সন্দেহ নেই।' সেটা গেল; কিন্তু আরও একটি 'লজ্জার কথা'
উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- বর্তমান সময়ে 'শিক্ষা ও তার অনুষঙ্গকে ঘিরে অবাঞ্ছিত ও অভূতপূর্ব' এক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
উপসংহারে বলা হয়েছে, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন 'আত্মদর্শনের' এবং সেই সঙ্গে 'অনুসন্ধানের'। তা ঠিক, অবশ্যই খুঁজে দেখতে হবে কারণ কী, কেন ঘটছে। তবে কারণটা কিন্তু ব্যক্তির ভেতরে ততটা নেই, যতটা আছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে এবং ব্যক্তি যে দুষ্ট হয়, সেটাও প্রধানত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কারণেই।
আজ থেকে দেড়শ বছর আগে ১৮৭২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় বঙ্গভূমিতে বাংলার চর্চার অভাব এবং ইংরেজি ভাষার দৌরাত্ম্য নিয়ে বিস্তর আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। তারপর কত ঘটনাই না ঘটল! ইংরেজ চলে গেল, বঙ্গভূমি স্বাধীন হলো, কিন্তু কই, বাংলা ভাষার চর্চা তো বাড়ল না। না বাড়ার কারণটা কিন্তু পরিস্কারই। সেটা হলো, এই যে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন ছিল, সেটা আসেনি। উল্টো পুঁজিবাদের দুঃশাসন আরও প্রবল ও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে।
ইংরেজ শাসকরা পুঁজিবাদী ছিল। তারা শোষণমূলক পুঁজিবাদী উন্নয়নে বিশ্বাস করত। তাদের হটিয়ে যারা শাসক হয়ে বসেছে, তাদের মতাদর্শিক দীক্ষাটাও ওই পুঁজিবাদেই। বস্তুত পুঁজিবাদই স্বাধীনতা পেয়েছে; মানুষ স্বাধীনতা পায়নি। মানুষ আরও শক্ত বন্ধনে আটকা পড়েছে- পুঁজিবাদের। দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়টির সমাপ্তিতে জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে সাহিত্যে যেন 'আত্মদর্শন' ও 'একান্ত অনুসন্ধান'-এর প্রতিফলন ঘটে। তা 'জগজ্জননী' কি পারবেন সাহিত্যে আত্মদর্শন ও অনুসন্ধানের প্রতিফলন ঘটাতে? সাহিত্য তো মানুষই সৃষ্টি করে এবং মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×