অনিয়ম, অমানবিক, অগ্রহণযোগ্য
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৬:১৬
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বিএনপি নেতা মো. আলী আজমের 'প্যারোলে মুক্তি' লইয়া যে সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার স্পষ্টত ব্যত্যয় ঘটিয়াছে, আইনবিদগণের বক্তব্যে তাহা প্রমাণিত। কারণ অভিযুক্ত আসামি শুধু নহে, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এহেন আচরণ নিয়মের মধ্যে পড়িতে পারে না। উপরন্তু সদ্য মাতৃহারা এক ব্যক্তির সহিত যাহা ঘটিয়াছে, উহাকে নিছক অনিয়ম আখ্যা দিবার অবকাশ নাই। তর্কের খাতিরে আইনে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়িতে আবদ্ধ রাখিবার বিধান মানিয়া লইলেও, মায়ের জানাজা পড়িবার সময়ও উহা খুলিয়া না দিয়া সংশ্নিষ্টরা চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়াছেন। রবিবার মাতৃবিয়োগের পর প্যারোলে মুক্তি পাইতেও যেইভাবে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে হইয়াছে, উহাও আমাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থার অসংবেদনশীলতার উদাহরণ হইয়া থাকিবে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে ঐ আলোকচিত্র ও খবর প্রকাশিত হইবার পর যে রূপ বিক্ষোভ ও বেদনা পরিব্যাপ্ত হইয়াছে, উহা যথার্থ। বস্তুত এই রূপ অবিমৃষ্যকারিতা আমাদের পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবেই মানিয়া লওয়া কঠিন।
ইহাও স্মরণে রাখিতে হইবে, আলী আজম কোনো ফৌজদারি অপরাধী নহেন। মামলার ধারা যাহাই হউক, তিনি রাজবন্দি মাত্র। রাজনৈতিক কারণেই তাঁহাকে কারাবাস করিতে হইতেছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এতদ্সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ইতোমধ্যে স্পষ্ট- ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটির বাদী হিসাবে যাঁহার নাম পুলিশ লিপিবদ্ধ করিয়াছে, তিনি ঘটনাস্থলেই ঐ দিন অনুপস্থিত। বরং পুলিশের একজন উপপরিদর্শকই তাঁহাকে বারংবার ফোন দিয়া 'অস্থির' করিয়া মামলার বাদী বানাইয়াছেন। আমরা জানি, সাম্প্রতিক কিছু মামলা সংবাদমাধ্যমে 'গায়েবি' আখ্যা পাইয়াছে। আলোচ্য মামলাটি যে সেইগুলিরই অন্তর্ভুক্ত, উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। এই রূপ একটা মামলার 'আসামি' বানাইয়া তাঁহার সহিত এহেন অনিয়ম ও অমানবিকতা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এই আশঙ্কাও অমূলক হইতে পারে না, আলোকচিত্রটির ব্যাপক প্রচারের মধ্য দিয়া বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কেও বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা পৌঁছাইতে পারে।
আমরা মনে করি, আলোচ্য ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গের পাশাপাশি আলী আজমের মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন ঘটিয়াছে। যাঁহাদের কারণে আমাদের এই দৃশ্য দেখিতে হইয়াছে, তাঁহারা কেবল অবহেলা ও ঔদাসীন্যের পরিচয় দিয়াছেন- বিষয়টি এতখানি সরল নহে। কারণ ঐ ব্যক্তির স্বজন ও গ্রামবাসীর অনুরোধ সত্ত্বেও হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি কয়েক মিনিটের জন্যও খুলিয়া দেওয়া হয় নাই। আমরা মনে করি, এই রূপ বেপরোয়া মনোভাবের মধ্য দিয়া সংবিধান, আইন, আদালত, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলিই প্রদর্শিত হইয়াছে। পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিগণ স্পষ্টতই সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অবজ্ঞা করিবার ন্যায় গুরুতর অপরাধ করিয়াছেন। আমরা দেখিতে চাহিব, দায়ী ব্যক্তিগণকে চিহ্নিতকরণে অবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হইয়াছে। কেবল 'আইওয়াশ' নহে; যথাযথ তদন্তপূর্বক দায়ীদের আইনের আওতায় আনিতে হইবে আইনের শাসনের স্বার্থেই। অন্যথায় এই রূপ অঘটন ভবিষ্যতে আরও ঘটিতে থাকিবে।
নিষ্ঠুর পরিহাসের বিষয়- কিছুদিন পূর্বে দৃশ্যত ডান্ডাবেড়ি না পরাইবার কারণে আদালত চত্বর হইতে দুইজন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছিল তাহাদের সহযোগীরা। আর একজন নিরীহ ও অবস্থাদৃষ্টে নির্দোষ বলিয়া অনুমিত ব্যক্তির নাজুক মানসিক অবস্থাকালে এই রূপ অসংবেদনশীলতা ঘটিল? ইহাতে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ তো বটেই, খোদ সরকারের সম্পর্কে জনমনে কী বার্তা যাইবে? স্মরণে রাখা জরুরি, রাজনৈতিক মতাদর্শ যাহাই হউক; প্রত্যেকের নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখিতে হইবে। ইহাও ভুলিয়া যাওয়া চলিবে না- চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। অদ্যকার ক্ষমতাসীন দল আগামীকল্য বিরোধী দলে গিয়া নিজেদের প্রতিষ্ঠিত নিকৃষ্ট দৃষ্টান্তের শিকার হইয়াছে- দেশে এই রূপ উদাহরণ কিঞ্চিৎ নহে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করিয়াছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত আলী আজমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনালগ্নের এই অঙ্গীকারত্রয় ভঙ্গ হইয়াছে। যত দ্রুত ইহার প্রতিকারের মধ্য দিয়া 'ড্যামেজ কন্ট্রোল' সম্ভব হইবে, ততই মঙ্গল।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়