ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

ভর্তুকি নয়, দুর্নীতি ঠেকান

ভর্তুকি নয়, দুর্নীতি ঠেকান

মিজান শাজাহান

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০:৫৩

গত অর্থবছরের বকেয়া ও চলতি অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি বাবদ ৪৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ১৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় লোকসান কমাতে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কৌশল নেবে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরই মধ্যে মূল্য বাড়ানোর পাশাপাশি এ খাতের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করে পিডিবিকে লোকসান কমিয়ে আনার পরামর্শ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে মর্মে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

অনিয়ম ও অপচয় রোধ করে লোকসান কমানোর যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তা শতভাগ বাস্তবসম্মত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে অনিয়মের খবরে আমরা হতাশ না হয়ে পারি না। জরুরি প্রয়োজনে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়। এসব কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। এসব অপচয় রোধে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীরবতা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বেঁধে দেওয়ার সময় এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত লাভ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে।

দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বিদ্যুতের আরেক দফা দাম বাড়ালে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদেরও হিমশিম খেতে হবে। গত ২১ নভেম্বর পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ইউনিটপ্রতি বাড়ানো হয় ১ টাকা ৩ পয়সা। যদিও তখন সরকার থেকে বলা হয়েছিল, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লেও খুচরা পর্যায়ে আগের দামই থাকবে। পাইকারি পর্যায়ে বাড়লে খুচরা পর্যায়ে সমন্বয় হবে, এটা জানা কথা। নীতিনির্ধারকরা রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও ভোক্তাদের মধ্যে তখন থেকেই চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। এর অল্পদিন পরই খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব প্রস্তাবের ওপর আগামী ৮ ও ৯ জানুয়ারি গণশুনানি হবে। শুনানির পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও গ্যাসে আর ভর্তুকি দেওয়া হবে না জানিয়ে উৎপাদন খরচ ভোক্তাদের বহনের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছিল সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। বিদ্যুৎ বিভাগের ভর্তুকির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অর্থ মন্ত্রণালয় সেই বার্তা আরও পরিস্কার করে দিল। আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার শর্তের মধ্যে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার বিষয়টি রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শও তারা দিয়েছে।

আগেই বলেছি, বিদ্যুতের আরেক দফা দাম বাড়ানো হলে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, ইউনিটপ্রতি দাম বাড়লে শুধু মাসিক বিল বাড়বে না। বরং বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়বে। যার প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুর দাম বেড়ে যাবে। সেচকাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে চাল থেকে শুরু করে অন্যান্য কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে। আধুনিক চাল, চিনি, আটা, ময়দা, মুড়ি কল বিদ্যুৎচালিত হওয়ায় এসব খাদ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা বঞ্চিত হতে পারে। সাশ্রয় করতে গিয়ে প্রযুক্তি খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হতে পারে এসব পরিবার। আমাদের মতো দেশে ভর্তুকিকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসতে রাষ্ট্র ভর্তুকির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে। কিন্তু বিদেশি দাতা সংস্থার পরামর্শে এ বিনিয়োগ তুলে নিলে তার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই ভর্তুকি বন্ধ না করে অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানোই হতে পারে সমাধান।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com

আরও পড়ুন

×