ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

দিবস

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সাম্প্রতিক স্বরূপ

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সাম্প্রতিক স্বরূপ

মোশতাক আহমেদ

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০:৫৪

ঢাকায় ১৯৭৩ সালের আজকের দিনে বিরোধী মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভিয়েতনামি জনগণের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশ গুলি করে। শহীদ হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদের। তখন থেকে দেশের বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ১ জানুয়ারি তারিখটিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

প্রশ্ন হচ্ছে- সাম্রাজ্যবাদ কী? ভ. ই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করেছিলেন পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে এবং এই শিরোনামে তিনি একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন রুশ বিপ্লবের ঠিক দেড় বছর আগে ১৯১৬ সালের জানুয়ারি-জুন সময়কালে। এই গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদের বিকাশের বৈশিষ্ট্য ও দ্বন্দ্বসমূহ তুলে ধরে এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন যে বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্তরে প্রবেশ করেছে। তখন থেকেই জোরেশোরে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি রাজনৈতিক সাহিত্যে উচ্চারিত হয়ে আসছে।

লেনিনের উল্লিখিত গ্রন্থ প্রকাশের পর গত একশ বছরের বেশি সময়ে বিশ্ব দেখেছে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। দেখেছে ঔপনিবেশিক শক্তির ভৌগোলিক নিগড় থেকে অনেক জাতিগোষ্ঠীর বেরিয়ে আসার সংগ্রাম। এই সময়ে সাধিত হয়েছে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এর সঙ্গে পালল্গা দিয়ে বিশ্ব জনসংখ্যার জ্যামিতিক উল্লম্ম্ফন পুঁজির বাজারকেও করেছে অস্বাভাবিকভাবে সম্প্রসারিত। প্রযুক্তি আর জনমিতির এই পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের দেশে দেশে সমাজ কাঠামো ভেঙেচুরে মানুষের চাহিদার ক্ষেত্র আমূল বদলে দিয়েছে। পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বসমাজের এই পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তন এনেছে তার কৌশলে।

সাম্রাজ্যবাদের এই কৌশল পরিবর্তন বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। শুরুতে কোনো দেশ দখল করে সেখানে বাজার প্রতিষ্ঠার যে কৌশল, বাস্তব কারণেই তা থেকে অনেক আগেই তারা সরে এসেছে। এর স্থলে গুরুত্ব দিয়েছে সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার। যেখানে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সেখানে পরোক্ষভাবে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই তার লক্ষ্য। মূল লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিস্তার। এ জন্য 'যেখানে যেমন সেখানে তেমন' নীতি নিয়েই এরা কাজ করে। একসময়ে সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ছিল ছলেবলে কৌশলে সম্পদসমৃদ্ধ দেশসমূহ দখলে নিয়ে সেই সব সম্পদের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা- যেমনটি এরা করেছে আফগানিস্তান এবং আফ্রিকার খনিজ-সমৃদ্ধ অনেক দেশে। এই ধরনের দখলদারিত্ব বহাল রাখতে তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে প্রক্সিযুদ্ধের। এর মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ দু'দিক থেকে মুনাফা লুটেছে। একদিকে এই সব দেশের সম্পদ লুণ্ঠন, অন্যদিকে এসব জায়গায় এক ধরনের কৃত্রিম নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে 'নিরাপত্তা বাণিজ্যের' সম্প্র্রসারণ।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই নাইন-ইলেভেনের ঘটনাকে পুঁজি করে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ পৃথিবীজুড়ে সন্ত্রাস দমনের নামে যে নিরাপত্তা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে আর যা-ই হোক না কেন, নিরাপত্তাসামগ্রীই বিক্রি হয়েছে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আর এই পরিস্থিতি সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য দেশে দেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, এসবের বীজ বুনে সামগ্রিক অবস্থা ভীতিপ্রদ করে তুলেছে যাতে মানুষ নিরাপত্তাসামগ্রী কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই যে বাংলাদেশে পর্যন্ত প্রতিটি দোকান, শপিংমলে নিরাপত্তা আর্চ, স্ক্যানার, সিকিউরিটি লক, সিসিটিভি ক্যামেরা, এসবের ব্যবসায়িক মূল্যটা কী, কেউ ভেবে দেখেছেন?

সাম্রাজ্যবাদ পুঁজির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখার কোনোই কারণ নাই- যেমনটি লেনিন বলে গেছেন একশ বছর আগে। তবে একজন চালাক ব্যবসায়ী যেমন কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য নিয়েই সারা জীবন বসে থাকেন না, বাজারের চাহিদা আর অবস্থা বুঝে পণ্য বদলান, প্রয়োজনে দোকানের কর্মচারীসহ এর খোলনলচেই বদলে দেয়, আবার অবস্থাভেদে নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে। সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী বলতে কোনো বিশেষ দেশকে বুঝতে গেলে ভুলের সম্ভাবনা থেকে যাবে। এটি একটি ব্যবস্থা; যা বিশ্বজুড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে সতত ক্রিয়াশীল। সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে এ নিজের রং বদলায়, বদলায় কৌশল। এর কাজ সহজ ও সাবলীল করার স্বার্থে বিভিন্ন কৌশলে কখনও সামরিক একনায়কতন্ত্র, কখনও 'গণতান্ত্রিক' একনায়কতন্ত্র কায়েমে সহযোগিতা করছে। কিন্তু এই সত্য তারা ভালোই বুঝে যে কোনো দেশে সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকলে তাদের এই পুঁজির শোষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই তারা অগণতান্ত্রিক সমাজ এবং সরকারকেই পছন্দ করে বেশি। সে কারণেই মুখে যা-ই বলুক না কেন, দেশে দেশে মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা পিছপা হয় না। অন্যদিকে মানুষের দৃষ্টি মৌলিক সমস্যা থেকে দূরে রাখতে তারা আকর্ষণীয় সব ধারণা নিয়ে হাজির হয়। যেমন- ধারণাগত মানবাধিকার নিয়ে তারা যত না উচ্চকণ্ঠ, মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে ততটা কখনোই নয়।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের নজর পড়ে আছে। এই ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি বাজারের চাহিদা ও পরিধি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে যত সরকার এসেছে, সবাই বিশ্ব পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষা করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। তারই ফলে দেশ আজ 'গোষ্ঠী পুঁজিবাদের' (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) এর জঁাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে চলেছে। দেশের মোট সম্পদের সিংহভাগ গুটিকয় ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি। ক্রমেই বেড়ে চলেছে সমাজে আয়বৈষম্য। কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ধনী থেকে ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব। আর, সরকার বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের প্রেসক্রিপশন মতে পুঁজিপতিদের স্বার্থে আইন প্রণয়নসহ সব ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ সবই সাম্রাজ্যবাদীদের খুশি রাখার প্রয়াস মাত্র। ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির এক লীলাক্ষেত্র।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও শক্তির ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শক্তিশালী করতে হবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পাল্টাতে হবে প্রচলিত ব্যবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ কাজে বাম দলসমূহকেই এগিয়ে আসতে হবে, পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা পুঁজিবাদ যেমন অবস্থা বুঝে তাদের কৌশল পাল্টায়, বামদেরও তাদের একশ বছর পুরোনো ধ্যানধারণা বদলিয়ে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখতে হবে, গত একশ বছরে বিশ্বজুড়েই সমাজ বদলে গেছে, বদলে গেছে শ্রেণির ধারণাও। তাই আজ নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে নতুন কৌশল নির্ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য মোকাবিলা করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী ও কার্যকর বাম সংগঠন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবসে- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক ও জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা

আরও পড়ুন

×