ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

নতুন বছরে রাজনীতি

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে, না অশান্তির নাকি হবেই না

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে, না অশান্তির নাকি হবেই না

এম এম আকাশ

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০:৫৬

নতুন বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বছরজুড়ে জাতীয় রাজনীতি আবর্তিত হবে। এখন এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে; নাকি নানা অশান্তির মধ্য দিয়ে নির্বাচন হবে; কিংবা নির্বাচন হবেই না?

দেশে এক সময়ে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না। দেখা গেল, যে ক্ষমতায় থাকে সে দল নিরপেক্ষ সরকার চায় না। যে ক্ষমতার বাইরে থাকে, সে চায়। এক সময়ে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন- একমাত্র পাগল ও শিশুরাই নিরপেক্ষ। যদিও এখন বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করছে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক সময় নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলন করেছেন। কিন্তু দলটি ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ বলছে- শাসনতন্ত্র অনুযায়ী দল নিরপেক্ষ সরকারের বিধান নেই।

স্পষ্টতই, ক্ষমতায় যাওয়াটাই মুখ্য। যদি ক্ষমতাসীন দল মনে করে ক্ষমতায় থাকার জন্য দল নিরপেক্ষ ব্যবস্থা সহায়ক হবে না, তাহলে তারা এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইবে না। অপরদিকে, ক্ষমতার বাইরে যারা তারা যদি মনে করে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দল নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সুবিধাজনক, তাহলে তাই চাইবে। এই বিরোধটির মীমাংসা নতুন বছরে হতে হবে- যদি নির্বাচন হতে হয়।

বিরোধের মীমাংসা হতে পারে কেবল একটি পদ্ধতিতে- যখন দুই দলই মনে করবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তা তাদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিএনপি যদি মনে করে, এখন যে অবস্থা রয়েছে তাতে নির্বাচনে গেলে বর্তমান অবস্থার থেকে তাদের উন্নতি হবে, তবে তারা নির্বাচনে যাবে। আবার একইভাবে আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে কিছু ছাড় দিলেও তারা ক্ষমতা চালিয়ে নিতে পারবে- তাহলে তারাও নির্বাচন করবে। তাই বলা যায়, নতুন বছর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলের এমন একটি স্বীকারোক্তি দরকার যে, তারা নির্বাচনে যাবে।

এই স্বীকারোক্তি ও ঐকমত্যের আগে কিছু বিষয়ে নিশ্চিত করতে হবে। যেমন- গত নির্বাচনের মতো একেবারেই আগের রাতে নির্বাচন না করে ফেলা, আগেই ব্যালট বাক্স ভরে না রাখা। এমনটা ঘটলে তো আর সমঝোতায় আসা যাবে না। আবার আওয়ামী লীগের কাছ থেকেও এমন প্রস্তাব আসতে পারে যে, বিরোধীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হবে না, প্রার্থীদের হয়রানি করা হবে না। ভোটকেন্দ্র স্বাভাবিক রাখা হবে, শক্তি বা ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে না। আমার ধারণা, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও এমন একটি আলোচনা ভেতরে হয়ে থাকতে পারে। যার জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখা গেল, ভোট আগেই হয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগ সমঝোতায় এলেও সেবার লক্ষণীয় ছিল- নির্বাচন পরিচালনা বা আয়োজনের জন্য নির্ভর করতে হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওপর। দেখা গেল, প্রশাসন ও পুলিশ মিলে 'সমঝোতা' আমলেই নেয়নি। ফলে ২০১৮ সালে নির্বাচনের এমন পরিণতি হয়েছিল।

আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রশাসন ও পুলিশের বাইরে আরেকটি পক্ষ রয়েছে- সংসদ সদস্য হতে চায় যারা। তারা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির এই সমঝোতা মানবে কিনা? কারণ, যারা ইতোমধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, তারা চাইবে যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে জয়ী হতে। গতবারে এমন ঘটনার জন্যই অনেক কেন্দ্রে ভোট সংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল।

যা হোক, গত নির্বাচনে বিএনপির একটি 'শিক্ষা' হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যাবে বলে মনে হয় না। এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেবে- এমন নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে কিনা? এই স্বীকৃতির প্রশ্নে চলে আসবে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। তাদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কী অবস্থায় রয়েছে, তার ওপর নির্ভর করবে, একতরফা নির্বাচনে স্বীকৃতির অভাব আওয়ামী লীগকে কতটা সংকটে ফেলতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিক। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়াকে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর রাশিয়ার একটি বড় বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কিছু মালপত্র নিয়ে রাশিয়ার একটি জাহাজ সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করলে তারা নীতি প্রয়োগ করবে। এখন রাশিয়ার জাহাজটি ভারতে নিয়ে মালপত্র খালাস করিয়ে বাংলাদেশে আনার কথা বলা হচ্ছে। এ থেকে আগামী নির্বাচন নিয়েও বৈশ্বিক মেরূকরণ বোঝা যায়। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আরও অনেকেই যে আগ্রহী, এটা বলা যায়।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন ঘিরে চারটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। প্রথমত, রাজনৈতিক গোলযোগে যথাসময়ে নির্বাচনই হলো না। দ্বিতীয়ত, সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় আওয়ামী লীগের অধীনে একতরফা নির্বাচন। চতুর্থত, বিএনপির নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার। সেটি বিএনপির জন্য কতটা সম্ভবপর, এখনই বলা কঠিন।

সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটেছে। এখন আগামী নির্বাচনকে ঘিরে তারা দাবি আদায়ে কতটা অনড় থাকতে পারে সেটাই প্রশ্ন। ওদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখনই অনমনীয় অবস্থানে।

সব মিলিয়ে বলা যায়- বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৩ সাল রাজনৈতিক উত্তাপ, সহিংসতা, এমনকি রক্তপাতের বছর হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে।

অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্নেষক

আরও পড়ুন

×