স্বীয় পদে কুঠারাঘাত

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৩:১৫
রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করিয়া তিন ফসলি জমি ও নদী দখল করিয়া এক মাগুরা জেলাতেই ৯৬টা ইটভাটা গড়িয়া উঠিবার যে চিত্র শনিবার সমকালে প্রকাশ হইয়াছে, উহা নিছক অঞ্চলবিশেষের চিত্র হইতে পারে না। এই আশঙ্কা অমূলক হইতে পারে না যে, হদিস করিলে দেশের অন্যান্য জেলাতেও মিলিবে একই পরিস্থিতি। বস্তুত অতীতেও বিভিন্ন সময়ে সমকালেই প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা অভিন্ন চিত্র দেখিয়াছি। অন্যত্রও মাগুরার ন্যায় ইটভাটার কারণে একদিকে কৃষিজমি কমিতেছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য নাজুক হইয়া পড়িতেছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, ইটভাটার জন্য প্রয়োজনীয় মৃত্তিকা সংগ্রহে ফসলি জমি 'ইজারা' লওয়া হইয়া থাকে কৃষকের নিকট হইতে- কখনও নগদ অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, কখনও আর্থসামাজিক কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটাইয়া। মাগুরাতেও উহার পুনরাবৃত্তি সুস্পষ্ট। কিছু ব্যতিক্রম অবশিষ্ট রাখিলে, কৃষক কিংবা ইটভাটা মালিক উভয়েই এই ক্ষেত্রে স্পষ্টতই নগদ নারায়ণের পাল্লায় পড়িয়া কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়াবলি বিবেচনা করিতেছেন না। তাঁহারা ভুলিয়া যান যে, সামান্য অর্থের জন্য কী অপূরণীয় ক্ষতি হইতেছে।
বস্তুত হাজার বছর ধরিয়া গড়িয়া ওঠা সম্পদ মুহূর্তের অবিমৃষ্যকারিতায় কীভাবে ধ্বংস হইয়া যাইতে পারে, কৃষিতেই উহার নজির সম্ভবত সবচাইতে অধিক। এইভাবে উর্বরাশক্তিসম্পন্ন ভূমির উপরের অংশের মৃত্তিকা বা 'টপ সয়েল' বিক্রয় করিবার সর্বনাশা এই প্রবণতার বিপদ অজানা নহে। আমরা জানি, ফসল উৎপাদনের জন্য শতকরা ৫ ভাগ যে জৈব উপাদান থাকা প্রয়োজন, উহা সাধারণত মৃত্তিকার উপর থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত রহিয়া যায়। মৃত্তিকার কর্ষণ স্তরেই রহিয়াছে চাষাবাদযোগ্য উদ্ভিদের মূল খাদ্যভান্ডার। 'টপ সয়েল' কাটিয়া লইলে কেঁচোসহ উপকারী পোকামাকড়ও বিলুপ্ত হইতে বাধ্য। ফলে ওই সব জমিতে সহজে ফসল জন্মে না। ফসল হইলেও উহার ফলন হইয়া পড়ে নগণ্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এইরূপ আত্মঘাতের জের ধরিয়া সার্বিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার জন্যই উদ্বেগ দেখা দিয়াছে। আমাদের স্মরণে রহিয়াছে, কয়েক বৎসর পূর্বে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী সংসদে দাবি তুলিয়াছিলেন- যে কোনো কাজে টপ সয়েল ব্যবহারে সার্বিক নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে হইবে। তাঁহার এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ ছিল যে, এমনকি বাঁধ নির্মাণসহ সরকারি ভরাট কাজেও মাটির উৎপাদনক্ষম অংশের যথেচ্ছ অপব্যবহার হইতেছে।
অস্বীকার করা যাইবে না, বর্তমান সভ্যতায় কংক্রিটাইজেশনের যে জোয়ার চলিতেছে, উহা হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিবার অবকাশ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু প্রতিবেশসম্মত উপায়েও যে নিরাপদ ও আরামদায়ক আবাস তৈয়ারি সম্ভব, গৃহনির্মাণের প্রাকৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে সেই চিন্তা আরও ছড়াইয়া দেওয়া দরকার। বিশেষত অমূল্য ফসলি জমি ও উহার শীর্ষস্তরের মাটি রক্ষায় নূ্যনতম ঔদাসীন্যের সুযোগ নাই। কৃষিপ্রধান একটা দেশে এইরূপ প্রবণতা স্বীয় পদে কুঠারাঘাতেরই নামান্তর। আমরা মনে করি, আত্মঘাতী এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে এবং যে কোনো মূল্যে বন্ধ করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে কৃষককে সাময়িক ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়া যাইতে পারে, যাহাতে তাঁহারা ইটভাটার নিকট ফসলি জমির মাটি বিক্রয় করিতে বাধ্য না হন। এই উদ্যোগে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলিও আগাইয়া আসিতে পারে। স্থানীয়ভাবে প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও জরুরি। আমাদের কৃষক ফসলি মাটি বিক্রয়ের যে ফাঁদে পড়িয়াছেন, সেইখান হইতে তাঁহাদের উদ্ধার করিতে হইবে সামষ্টিক স্বার্থেই।
এই প্রশ্নও তুলিতে হইবে- পরিবেশবান্ধব তথা 'আধুনিক প্রযুক্তি-সংবলিত' ইটভাটা লইয়া এত আয়োজন ও আওয়াজ সত্ত্বেও উহা দিয়া দেশের অবকাঠামো নির্মাণে প্রয়োজনীয় ইটের চাহিদা মেটানো যাইতেছে না কেন? কেন অদ্যাবধি বিশাল বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে পরিবেশ বৈরী ইটভাটাগুলি মুখ ব্যাদান করিয়া থাকে? ইটভাটায় মৃত্তিকার পাশাপাশি আগুন জোগান দিতে গিয়া কীভাবে ভূমি ও উর্বরাশক্তির ক্ষতির পাশাপাশি বৃক্ষরাজিও কাটা পড়িতেছে, সেই চিত্র কেবল মাগুরাতেই দেখা যাইতেছে না। স্বীকার করিতে হইবে, পরিবেশবাদীগণের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রতি সাড়া দিয়া সরকার পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ করিতে 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন' সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু বাস্তবে যদি ইটভাটায় ভূমি ও বৃক্ষ ভক্ষণ বন্ধ না হয়, সকলই গরল ভেল!