ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রতিবেশী

ভারতে নতুন করে গরিব মারার বাজেট

ভারতে নতুন করে গরিব মারার বাজেট

সোনিয়া গান্ধী

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:৫৭

সদ্যসমাপ্ত ভারত জোড়ো যাত্রায় যাত্রীরা কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হেঁটেছেন। এই যাত্রার মাধ্যমে সর্বস্তরের লাখ লাখ ভারতীয়র সঙ্গে কথা হয়েছে। ভারত যে গভীর অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পতিত হচ্ছে, সে সম্পর্কে মানুষের কণ্ঠে ব্যাপক হতাশা দেখা গেছে। দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ বা শহুরে ভারতীয়রা মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও আয় হ্রাসের ত্রিবিধ সংকটে দিন পার করছে। ২০২৩-২৪ বাজেটে এসব জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোনো স্পষ্ট পদক্ষেপ নেই। উপরন্তু দরিদ্র ও দুর্বলদের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে তাদের আরও খারাপ অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ২০০৪-'১৪ সময়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার মানুষের অধিকারে যে সুদূরপ্রসারী আইন করেছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকার তা অনুসরণ না করে দরিদ্রদের সংকট আরও বাড়িয়েছে।
স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল- প্রত্যেক ভারতীয়র জন্য একটি সুন্দর জীবন। শুধু তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে নয়; বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের ক্ষমতায়নের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। ইউপিএ সরকারের সময়ে মানুষের অধিকারের জন্য সেভাবেই আইন করা হয়। এমন আইন নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করে এবং শিক্ষা, খাদ্য, কর্মসংস্থান ও পুষ্টি নিশ্চিতে সরকারকে দায়বদ্ধ করে। অধিকারের এসব আলোচনা যে প্রধানমন্ত্রীর অপছন্দ, সেটি তিনি গোপন করেন না। তিনি সংসদে তাঁদের উপহাস করে শুরু করেছিলেন। কিন্তু কভিড-১৯ এর সময় তাদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। এই বাজেটে তিনি মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন তথা এমজিএনআরইজিএতে এত কম তহবিল বরাদ্দ দিয়েছেন, যা এক দশকে দেখা যায়নি। এই তহবিল ২০১৮-১৯ স্তরের নিচে নেমে এসেছে। স্কিমের অধীনে মজুরি ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারের হারের নিচে রাখা হচ্ছে এবং শ্রমিকদের সময়মতো বেতন পাওয়া নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

ইউপিএ সরকার সর্বশিক্ষা অভিযানের জন্য যে তহবিল গঠন করেছিল, আমাদের সে স্কুলগুলোও তহবিলের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা তিন বছর ধরে স্থবির থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিশুরা পুষ্টিকর খাবার কম পাবে। কারণ এই বছর স্কুলে মিড-ডে মিলের জন্য তহবিল ১০ শতাংশ কমে গেছে। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে পাঁচ কেজি বিনামূল্যের খাদ্যশস্য বন্ধ হওয়ার পর থেকে দরিদ্রদের রেশন অর্ধেক করা হয়েছে। একইভাবে সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা এবং বয়স্কদের জন্য পেনশন- সবখানেই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। উপরন্তু গত চার বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অর্থ হলো- ২০১৮ সালের তুলনায় এখন মানুষ প্রায় এক-চতুর্থাংশ কম ক্রয় করে। অপর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দেওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ম্ফীতি উভয় সংকটের সংমিশ্রণের সরাসরি প্রভাব ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের ওপর ভয়াবহভাবে পড়ছে।
এই নীরব আক্রমণটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। অথচ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করা হলো- 'পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হয়েছে।' কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, জিডিপি প্রাক-মহামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ শুধু ধনী ভারতীয়রাই এই পুনরুদ্ধারের সুবিধা ভোগ করেছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া-আরবিআইর ভোক্তা জরিপ অনুসারে, বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে প্রতি মাসে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। কারণগুলো স্পষ্ট- নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং নরেন্দ্র মোদি সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের কর্মসংস্থান সেভাবে হচ্ছে না। অন্যদিকে আয় কমে যাওয়ার পরও মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই সংকটের সময়ে সামাজিক খাতে বরাদ্দ কমানোর পরও প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ নীরব। বাজেটের আয়তন বাড়ার পরও কেন এই অবস্থা, তা বোঝা কঠিন নয়। বিশেষজ্ঞরা সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তহবিলের একটি বড় অংশ যে শুধু সরকারের বন্ধু এবং পুঁজিপতিদের কাছে পৌঁছাতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁদের সতর্ক পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। তবে এই সন্দেহগুলোকে এক পাশে রেখেও একটি বৃহত্তর বিষয় রয়েছে। সেটি হলো, মানব উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদ বা দীর্ঘমেয়াদে যে অবকাঠামোগত ব্যয় করা হচ্ছে, সেখানে সমস্যা রয়েছে।
কাজ দেওয়া, খাবার দেওয়া, ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা, সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কিংবা মানুষের হাতে নগদ প্রদানের মতো সামাজিক কর্মসূচি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। বড় প্রকল্পগুলোতে ব্যয় শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর জনগণের কল্যাণে কতটা কাজ করবে, তা অনিশ্চিত। তার তুলনায় মানুষকে সরাসরি সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের সংকট দ্রুত কাটতে সহায়তা করে। দীর্ঘমেয়াদে ইতিহাস আমাদের বলছে, একটি সুস্থ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই সমৃদ্ধির মৌলিক ভিত্তি। তবে উন্নত দেশে অবশ্যই মহাসড়ক, রেলপথ, বন্দর ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। একই সঙ্গে এগুলো পরিচালনায় দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকের। কৃষকদের প্রয়োজন খাদ্য উৎপাদনের জন্য। এমনি করে শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, শিল্পীসহ অনেকের প্রয়োজন, যাঁরা তাঁদেরসহ নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন। সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য খাতে তহবিল ঘাটতি দরিদ্রদের আজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে এবং আমাদের আগামী দিনের অগ্রগতি স্তব্ধ করে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীতি তাঁর কিছু ধনী বন্ধুর উপকার করলেও দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের ক্রমাগত বিপর্যয়ের দিকে পরিচালিত করবে। তাঁর জিএসটি নীতি তথা গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্সে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনটি খামার আইন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা কৃষি অবহেলারই নামান্তর। ধ্বংসাত্মক বেসরকারীকরণ নীতির মাধ্যমে মূল্যবান জাতীয় সম্পদকে কিছু মানুষের হাতে সস্তায় তুলে দেওয়া হয়েছে, যা বিশেষ করে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়াতে সাহায্য করছে। এমনকি কোটি কোটি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ভারতীয়র কষ্টার্জিত সঞ্চয়ও হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ ভারতীয় লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও ভারতের স্টেট ব্যাংকের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নির্বাচিত বন্ধুদের মালিকানাধীন দুর্বল সংস্থাগুলোয় বিনিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীরা 'বিশ্বগুরু' ও 'অমৃত কাল' বলে উচ্চস্বরে ধ্বনি তুলছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ও পছন্দসই ব্যবসায়ীকে জড়িয়ে ফাঁস হওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে চলছে তোলপাড়। এখন প্রত্যেক ভারতীয়র কর্তব্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সরকারের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা; একই সঙ্গে এমন পরিবর্তন আনা, যা মানুষ দেখতে চায়।

সোনিয়া গান্ধী :কংগ্রেস সংসদীয় দলের সভাপতি; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×