ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

বিদেশে নিরাপদ দেশে ঝুঁকি

বিদেশে নিরাপদ দেশে ঝুঁকি

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:৪৮

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ট্রেনকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বাহন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবসার প্রসারের স্বার্থে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে রেলওয়ে খাতটি বছরের পর বছর অবহেলিত থেকে গেছে বলে অভিযোগ আছে। অবহেলায় থাকা যেমন কাম্য হতে পারে না, তেমনি রেলের বিদ্যমান যাত্রাপথকেও অনিরাপদ থাকতে পারে না। অন্যান্য দেশে রেলপথকে নিরাপদ ভাবা হলেও বাংলাদেশে যে তা এখনও নিরাপদ নয়, তার সর্বশেষ উদাহরণ কুমিল্লার রেল দুর্ঘটনা।

সিগন্যাল ভুলের কারণে একই লাইনে প্রবেশের ফলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে যাত্রীবাহী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। এতে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের সাতটি ও মালবাহী ট্রেনের একটি, মোট আটটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। জানা যায়, হাসানপুর রেলস্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে অবহেলার কারণে আপ লাইনের ২ নম্বর লাইনের সিগন্যাল পয়েন্ট ঠিক করতে দেরি হওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

তবে এ দুর্ঘটনার জন্য নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাসানপুর স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার মাহমুদুল ইসলাম। দুর্ঘটনার পরদিন তিনি সমকালকে জানিয়েছেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় আমরা বিকল্প পদ্ধতিতে সিগন্যাল পয়েন্ট সচল করতে চেয়েছিলাম। এর আগেই সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন লুপ লাইনে ঢুকে মালবাহী ট্রেনে ধাক্কা দেয়।’ স্টেশন ম্যানেজারের বক্তব্য থেকে যা জানা যাচ্ছে, তা আরও ভয়াবহ। অর্থাৎ ট্রেন চলাচলে বিদ্যুৎ দরকারি না হলেও লাইনের নিরাপত্তার জন্য বিদ্যুতের অপরিহার্যতা রয়েছে। অথবা বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প কোন পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করতে হবে।

যে কোনো দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যায়, একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারপর সব তৎপরতা থেমে যায়। দুর্ঘটনার কারণ বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের সতর্কতার দিকটিও মেনে চলা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের দুর্ঘটনায় আন্তঃনগর সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের চালকসহ ৩ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

সড়কের তুলনায় রেলপথের দুর্ঘটনা অনেক কম। তবু যত সংখ্যায় ঘটে, ততটাও স্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশে রেলপথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অস্বাভাবিক মাত্রার দায়িত্বহীনতার ফল। বাংলাদেশে রেলপথে দুর্ঘটনার অধিকাংশই রেলক্রসিং সংক্রান্ত। রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় যাত্রীবাহী বা পণ্যবাহী যানবাহন ও মানুষ চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে। রেলক্রসিং সংক্রান্ত দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সাধারণত ক্রসিংয়ের নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোর দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্টেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে অবহেলাও দুর্ঘটনার কারণ। বিশেষ করে ব্রাহ্ম‏ণবাড়িয়ার দুর্ঘটনা বাংলাদেশের রেল দুর্ঘটনায় বড় ঘটনা হিসেবে আমাদের সামনে দায়িত্বে অবহেলার বড় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

স্টেশন ম্যানেজার কিংবা নিরাপত্তাকর্মীদের অবহেলার কারণে রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহত হলে তারা প্রথমে কিছুদিন পালিয়ে থাকে। তাদের চাকরি স্থায়ী নয়, তবু রেল বিভাগ হয়তো তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। তারপর একটা সময়ে বিষয়টি সবাই ভুলে যায়। কখনও অপমৃত্যুর মামলা হয়। সাধারণত সেসব মামলার নিষ্পত্তি হয় না; কারও শাস্তিও হয় না। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। রেলক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানিও চলতে থাকে। সারাদেশের রেলক্রসিং নিরাপদ করতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। রেল বিভাগ এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় বলে প্রতীয়মান নয়। তা ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার জন্য যে কোনো দুর্ঘটনায় আইনানুগভাবে তার শাস্তি বিধান করা জরুরি। আমরা আশা করব, এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে যথাযথ সতর্কতা পালন করবে। কারণ যে কোনো অসতর্কতা বা অবহেলার পরিণতি কী হতে পারে, এ দুর্ঘটনা আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে।

এহ্‌সান মাহমুদ : সহসম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×