ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক

তুরস্কে এরদোয়ান যুগের অবসান হচ্ছে

তুরস্কে এরদোয়ান যুগের অবসান হচ্ছে

মঞ্জুরে খোদা

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:৪৮

আগামী মাসে তুরস্কের জাতীয় নির্বাচন। এমন এক সময় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যে বছর ‘গণপ্রজাতন্ত্রী তুরস্ক’ প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্ণ হবে। দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসেন। তিনি প্রথম তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার মেয়র নির্বাচিত হন (১৯৯৪-১৯৯৮)। মেয়র হিসেবে সফল হওয়ার পর তিনি জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে ২০০১ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এ.কে.) প্রতিষ্ঠা করেন। দল গঠনের এক বছরের মাথায় দলকে ক্ষমতার কাছে নিয়ে যান। ২০০৩ সালে তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার পর থেকে তিনি টানা ২১ বছর ক্ষমতায় আছেন (২০০৩-২০২৩)। এর মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং ২০১৭ থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুই মেয়াদ পূরণ করতে চলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তন করে তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করে নিজের হাতে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা নেন। ক্ষমতার প্রভাব বলয় বাড়াতে থাকেন। হয়ে ওঠেন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।  তাঁর মেয়াদকালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ২০১৬ সালে। সে সময় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার এক ষড়যন্ত্র তিনি ব্যর্থ করে দেন। এ ঘটনায় তিনি প্রতিপক্ষের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালান। অনেককে কঠোর শাস্তি প্রদান এবং ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করেন। এই ঘটনার পর আসন্ন মে মাসের নির্বাচনে তিনি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক তুরস্কের নির্বাচন জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একযোগে অনুষ্ঠিত হবে। অনেক জোট, দল অংশগ্রহণ করলেও রাষ্ট্রপতি পদে মোট ৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে প্রধানত দুইজন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী– ক্ষমতাসীন এ.কে. পার্টির প্রধান, রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি থেকে কেমাল কিলিচদারুগলু।

প্রধান বিরোধী দল এরদোয়ানের শাসনকালের নানা ব্যর্থতাকে পুঁজি করে প্রচারণা চালাচ্ছে। যেমন ১. মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট, ২. কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবধারা রক্ষা,  ৩. রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, ৪. যৌথ নেতৃত্ব ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ৫. ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম দূর করা।

এরদোয়ানের প্রধান বক্তব্য উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ইস্যু। তাঁর বক্তব্য– নির্বাচনে যদি জনমোর্চা ক্ষমতায় আসে সেটা স্থায়ী হবে না। এতে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট দেখা দেবে। কেননা, বিরোধীদের মধ্যে নানা বিষয়ে টানাপোড়েন ও মতবিরোধ বিদ্যমান। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তিনি একটা নিজস্ব ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন। ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলায় মুসলমানদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা লক্ষণীয়। তবে তিনিও সমালোচনার বাইরে নন। তাঁরও নেতিবাচক দিক আছে।

জনমোর্চার নেতা কেমাল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি এরদোয়ানের মতো অতটা ক্যারিশমাটিক না হলেও বিরোধীদের একক প্রার্থী হিসেবে তিনি বাড়তি কিছু সুবিধা পাবেন। তিনি এরদোয়ানবিরোধীদের সব ভোট আশা করছেন।

বিভিন্ন জনমতে তাঁর পক্ষে পাল্লা কিছুটা ভারিও দেখা যাচ্ছে। তবে নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থার পরিবর্তন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, এরদোয়ান একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং অনেক নির্বাচন সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। নির্বাচন সামনে রেখে তিনি তাঁর রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক অর্জনগুলো একে একে সামনে নিয়ে আসছেন। ভোটাদের আস্থায় নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

তুরস্কের নির্বাচনে পরিষ্কার তিন ধারা বিদ্যমান: দক্ষিণপন্থি, মধ্যপন্থি ও বামপন্থি ধারা। ক্ষমতাসীন এ.কে. পার্টির জনমোর্চা ইসলামপন্থি ভাবধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে। কর্তৃত্বপরায়ণ যে কোনো শাসকের উদ্দেশ্য থাকে নানা কৌশলে ক্ষমতায় থাকা। জনতুষ্টিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনসমর্থন ও ভোট আদায়। সে ক্ষেত্রে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। যেমন তুরস্কের দীর্ঘ ঐতিহ্যের চার্চ হায়া সোফিয়া চার্চকে পরবর্তি সময়ে জাদুঘর ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত ছিল, সেটাকে মসজিদে রূপান্তর করেছেন।

সিএইচপির নেতৃত্বে জাতীয় মোর্চা ধর্মনিরপেক্ষ ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। যদিও তাদের জোটেও ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের অবস্থান আছে। তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের হাতে গড়া প্রাচীন ও বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ এই রাজনৈতিক দল সিএইচপি আগের মতো দৃঢ় আদর্শিক অবস্থানে নেই। কেননা, তারাও ক্ষমতার প্রশ্নে ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা ও আপস করেছে বা করতে হয়েছে। যে কারণে এই দলের অনেক সদস্য-সমর্থকের মধ্য এটা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং এ কারণে অনেকে তাঁদের সমর্থন প্রত্যাহার করে বামপন্থি এইচডিপি জোটকে সমর্থন করছেন। এমনকি সরকারি দল থেকে আসা নেতৃত্বকেও মোর্চায় স্থান দেওয়ায় একটা অংশের ক্ষোভ আছে।

বামপন্থি এইচডিপির নেতৃত্বে শ্রমমুক্তি জোট দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের শক্তিশালী কোনো অবস্থান না থাকলেও এই দুই বলয়ের বাইরে একটা বিকল্প তৈরির প্রচেষ্টা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

ইউরো নিউজ লেটার ও তুরস্কের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওআরসির সর্বশেষ জনমত জরিপে জানা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনে বিরোধী সিএইচপি নেতা জনমোর্চার প্রার্থী কেমাল ক্ষমতাসীন এ.কে. পার্টির এরদোয়ানের চেয়ে এগিয়ে। ভোটাররা যেমন কর্তৃত্ববাদী ও এককেন্দ্রিক শাসক চান না; এ অবস্থার পরিবর্তন চান; আবার কোনো বিরোধপূর্ণ অস্থিতিশীল কোনো সরকার তাঁরা আশা করেন না। নানা হিসবা বলছে, সংসদ সদস্যদের ভোট ভাগাভাগি হলেও রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অন্য রকম। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিতে হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাকিটা সময়ই বলবে– গণপ্রজাতন্ত্রী তুরস্কের ১০০ বছর পূর্তির উৎসব কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত সিএইচআরের হাতে হবে, না কর্তৃত্ববাদী শাসক এরদোয়ানের আয়োজনে হবে?

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×