এমন সমন্বয়হীনতার জবাব কী

পুলিশের লাঠিচার্জের সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা ছুটোছুটি করতে থাকেন- সমকাল
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০
মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ, নিকলী (কিশোরগঞ্জ)। কলেজটি স্থাপিত হয় ১৯৯৪ সালে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মানবিক ও বাণিজ্য শাখা দিয়ে কলেজটি যাত্রা শুরু করলেও ২০১২-১৩ সেশন থেকে ডিগ্রি কোর্স চালু হয়। কলেজটিতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অর্থাৎ গত ১০ বছর ধরে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ানো হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও অর্থনীতি।
আরেকটি বিষয়। প্রতিষ্ঠার ২৯ বছরের মাথায় (১৯৯৪-২০২৩) আজ পর্যন্ত নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজে বিজ্ঞান শাখা (আইএসসি) খোলা সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বা নানা সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। মানবিক বিভাগ হলো, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ হলো, স্নাতক হলো; এমনকি কলেজটি সরকারীকরণও হলো। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এত বছরেও উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ না খোলার নজির আরও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই।
কিশোরগঞ্জেরই আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান– রোটারি কলেজ অষ্টগ্রাম। স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালে। এ কলেজটিও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মানবিক ও বাণিজ্য শাখা দিয়ে শুরু করা হয়। ডিগ্রি কোর্স পড়ানো হয় ১৯৯৯-২০০০ সেশন থেকে। ডিগ্রি অর্থাৎ স্নাতক শ্রেণিতে বিষয় হিসেবে এখানে পড়ানো হয় ইতিহাস, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। কলেজটিতে বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞান চালু থাকলেও তা শুধু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। ফলে ডিগ্রি স্তরে বিষয় বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। এ কলেজটিও সরকারি (২০১৮)। তবে এর অবস্থাও তথৈবচ। প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরের মাথায় (১৯৮৬-২০২৩) আজ পর্যন্ত অষ্টগ্রাম রোটারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ (আইএসসি) খোলা সম্ভব হয়নি।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা-ব্যবস্থাপনায় ‘স্কুল পরিদর্শক’ (ইন্সপেক্টর অব স্কুলস) এবং ‘কলেজ পরিদর্শক’ (ইন্সপেক্টর অব কলেজেস) নামে দুটি পদ রয়েছে। তাঁদের কাজ হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন। উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন তথা সেই ব্রিটিশ আমলে ইন্সপেক্টর পদ সৃষ্টির পর থেকেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মজার মজার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত এবং রসবোধসম্পন্ন লেখক ও সাহিত্যিকরা (যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী) সৃষ্টি করেছেন নানা ধরন ও মেজাজের অনেক রচনা। এমন বহু হাস্যরসাত্মক ঘটনা ও প্রচলিত গল্প নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সচেতন মহলে বলতে গেলে প্রতিনিয়ত খোশ গল্প, আলাপ-আলোচনা হয়। সোমনাথ মন্দির বা হরধনু ভাঙা কিংবা ‘গার্লিক স্যার’-এর গল্প কার না জানা!
এসব সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ইন্সপেক্টর বা পরিদর্শকরা ছিলেন অনেকটাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কস্বরূপ। অন্যদিকে শিক্ষা-বিভাগ বা সরকারের পক্ষ থেকে একেকজন ইন্সপেক্টর ছিলেন আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক। দায়িত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালোমন্দ সম্পর্কে তিনি সময়মতো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। যে কোনো সময় তিনি এসে যেতে পারেন; না জানি কোন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা তাঁর নজরে পড়ে যায়! আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠির মাধ্যমে অথবা যে কোনো উপায়েই হোক পরিদর্শকের আগমনের সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছার পর থেকেই এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ব্যস্তত্রস্ত-কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীনতার পরও স্কুলে আমরা দেখেছি অন্য সবকিছুর মধ্যে প্রস্তুতি হিসেবে অন্তত নির্দিষ্ট ওই দিনটিতে সবার পরিষ্কার পোশাক পরে স্কুলে আসতে হয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার রয়েছে আরও বিভিন্ন কারণ। আজকাল আর সে আশঙ্কা নেই। পরিদর্শকদের কাজ এখন ঢাকা বা সদরদপ্তরে। বলা যায়, চার দেয়ালের গণ্ডিতেই আবদ্ধ। সেখানে থেকেই সবকিছু দেখভাল ও প্রয়োজনে ‘ম্যানেজ’ করা হয়।
শুরুতে সামান্য বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজ জেলার মাত্র দুটি কলেজের কথা উল্লেখ করেছি। শেষ করি কিশোরগঞ্জের আরেকটি কলেজের গল্প দিয়ে। নিকলীর শহীদ স্মৃতি কলেজের স্নাতক শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে অর্থনীতির মতো একটি বিষয় বাধ্যতামূলক পড়তে হচ্ছে। ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাতা থেকে কলম তুলে ছলছল চোখে বিমূঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি আমি। অথচ বছরের পর বছর ‘অর্থনীতির বেড়াজালে’ ওদের এভাবেই বন্দি থাকতে হচ্ছে। পছন্দ-অপছন্দ কিংবা বাছাবাছির কোনো বালাই নেই। অথচ কোনো প্রতিকার নেই; কেউ নেই দেখার! শিক্ষার্থীদের মতোই প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কথা না হয় বাদ দিলাম; তাঁরা অসহায় বা নিরুপায়; কিন্তু কলেজ পরিদর্শকরা? তাহলে কলেজ পরিদর্শকদের কাজ কী? খোঁজ নিলে সারাদেশে এমন আরও ডজন ডজন, এমনকি শত শত ‘হতভাগ্য’ প্রতিষ্ঠান পাওয়া যেতে পারে।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক