অধিকার
কাঠ বাণিজ্য বনাম লেমুপালং পাড়াবন সুরক্ষা

পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৩ | ১৮:০০
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের পরবকে ম্রোরা বলে চানক্রান। চৈত্র-বৈশাখে যখন বিজু, বিষু, সংক্রান্তি, সাংগ্রাই, নববর্ষ, হংঅরানী কিংবা বৈসুক হয়, তখনই ম্রো গ্রামে আয়োজিত হয় চানক্রান। শাল ফুল ফুটলে যেমন সাঁওতাল সমাজ বাহা পরবের আয়োজন করে; ক্লো-প্লাও ফুটলে ম্রোরা আয়োজন করে চানক্রান। চানক্রানের আগে ম্রো ছেলেমেয়েরা পাহাড়-জঙ্গল থেকে ক্লো-পাও ফুল সংগ্রহ করে। কিন্তু বান্দরবানের লামার সরই পাহাড়ে গত ২০ বছরে কমেছে ক্লো-পাও ফুলের বিস্তার। অবশ্যই পরিবেশদূষণ কিংবা জলবায়ু বিপর্যয় আছে। কিন্তু সরই পাহাড়ে তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা তৈরি করেছে মানুষ।
সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার চাইল্যা ঝিরির পাশে তিনটি ম্রোপাড়া। পুরাতন ও নতুন দেওয়ানপাড়া এবং বাক্কাপাড়া। পাড়াবাসী অভিযোগ করেছেন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাদের সংরক্ষিত পাড়াবন থেকে গাছ কেটে নিচ্ছেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার এক কাঠ ব্যবসায়ী। ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি সরই পাহাড়ের লেমুপালং মৌজায় ম্রোদের সামাজিকভাবে সংরক্ষিত পবিত্র ‘মৌজা রিজার্ভ বা পাড়াবন’ বিনষ্ট করেছেন এবং প্রথাগত রীতি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে সেখানকার গাছ কাটছেন। প্রতি বছর জানুয়ারি মাস এলেই তাঁর ভাড়া করা ৫০-৬০ জন বহিরাগত শ্রমিক মেশিনপত্র নিয়ে গাছ কাটতে চলে আসে এবং বর্ষাকালের আগ পর্যন্ত গাছ কাটে। ঘনফুটের মাপে জোয়ান গাছগুলো কাটা হয়, কিন্তু চিরতরে বিনাশ হয় লতাগুল্ম ও বাস্তুতন্ত্র। হাতি দিয়ে গাছ টানানোর নির্মম কাজটিও চলে এখানে। দৈনিক সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়ায় হাতিগুলো আনা হয়। কাটা গাছ টানতে টানতে শরীরে ঘা আর ক্ষতঅলা হাতির আহাজারি শুনতে পায় না কোনো বিভাগ কিংবা মন্ত্রণালয়।
গাছ পরিবহনের সুবিধার্থে ইতোমধ্যে ওই এলাকার ঝিরি ও পাহাড় কেটে-ছেনে তছনছ করা হয়েছে। কেবল পাড়াবন নয়, এলাকাবাসী নিজেদের বড় করা গাছ প্রয়োজনে এই ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কারও কাছে বিক্রিও করতে পারে না। এ এক জটিল সিন্ডিকেট। কম দামে বিক্রি করে সেই টাকা পেতে অপেক্ষা করতে হয় বহু সময়। তবে সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জোত-পারমিটের মাধ্যমে মৌজাপ্রধান থেকে আজীবনের জন্য এই বাগান তিনি কিনেছেন এবং গাছ কাটা ও হাতি দিয়ে গাছ টানানো বৈধভাবেই করছেন।
লেমুপালং মৌজার বর্তমান হেডম্যান কাইনওয়াই ম্রো। এর আগে হেডম্যান ছিলেন তাঁর বাবা চন্টু ম্রো। অভিযোগ উঠেছে, নিরক্ষর চন্টু ম্রোর স্বাক্ষর জাল করে হয়তো একটি চুক্তিপত্র তৈরি করে কাজটি করা হচ্ছে।
লেমুপালং মৌজার ১৩টি ম্রো পরিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, কাটা গাছ টানার কাজে ব্যবহৃত হাতির বিষ্ঠায় বিনষ্ট হচ্ছে পানীয় জলের ঝিরি। পূর্বে কালা পাহাড়, পশ্চিমে পালং খাল, উত্তরে শিলঝিরি এবং দক্ষিণে বমু খালের সীমানা অঞ্চলে বন বিনষ্টের এই দস্যুতা চলছে। হাতির বিষ্ঠায় দূষিত পানি পান করে স্কুলের শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। কেবল গাছ নয়; পাহাড়-ঝিরির পাথরও তুলে নিতে চেয়েছিল ওই ব্যবসায়ী গং। এলাকাবাসীর বাধার মুখে তা বন্ধ আছে। ২০১৫ সালে ম্রোরা নির্বিচার গাছ হত্যার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিল। পরে ওই কাঠ ব্যবসায়ী তিনবার ম্রোদের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও মাদকের মামলা দেয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০২০ সালে মামলা খারিজ হয়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী আজ পবিত্র বৃক্ষ ও পবিত্র বনভূমির ধারণা সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশেও ‘বন্যপ্রাণী আইন (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) ২০১২’ অনুযায়ী সামাজিকভাবে সংরক্ষিত এমন পবিত্র স্মারকে প্রাণ-প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় অঞ্চলেই আদিবাসী সমাজে সামাজিকভাবে সংরক্ষিত পবিত্র বনভূমির অস্তিত্ব আছে। মৌজা রিজার্ভ বা পাড়াবন নামে পরিচিত এসব অরণ্য বৈচিত্র্য এবং বিন্যাসে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। প্রতিটি জাতিসত্তার কাছে এসব বনের নিজস্ব নাম ও সুরক্ষাবিধি আছে।
ম্রোরা সামাজিকভাবে সংরক্ষিত পাড়াবনকে বলে ‘কুয়া-বাম’। লেমুপালং মৌজায় ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রথাগত বিধিতে সংরক্ষিত ৩০ একরের এক প্রাচীন কুয়া-বাম আছে। কুয়া-বাম এলাকাটি কোনো ব্যক্তির নয়– সমাজের, একটি অঞ্চলের। এখানকার কোনো বৃক্ষ-প্রাণসম্পদ একতরফাভাবে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা যায় না। এখানকার বৃক্ষ-প্রাণ-প্রজাতি ব্যবহারে বহু সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি মানা হয়। পাড়াবনের সুরক্ষা হেডম্যানের দায়িত্ব। কারও নতুন ঘর তৈরির দরকার হলে বা কোনো কারণে গাছ, ঔষধি গুল্মের দরকার হলে সেটি আহরণের সামাজিক সিদ্ধান্ত হয়। বহু গবেষণা প্রমাণ করেছে– এমন সামাজিকভাবে সংরক্ষিত বনগুলো বহু বিলুপ্ত প্রাণের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু আলোচ্য কাঠ ব্যবসায়ী প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের এই প্রথাগত সংরক্ষণবিধি অমান্য করেছেন। লেমুপালং কুয়া-বামের পবিত্র মর্যাদা অস্বীকার করে বছরের পর বছর এই এলাকা থেকে গাছ কেটে সমগ্র এলাকার বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট ও অনিরাপদ করে রেখেছেন।
নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলায় সেগুলোর ওপর নির্ভরশীল পাখি ও বন্যপ্রাণী উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে। বন্যপ্রাণীর বিচরণস্থল ও খাদ্যের উৎস সংকুচিত হয়েছে। সরই পাহাড়ে প্রভাবশালী বহিরাগতদের এমন কাঠ বাণিজ্য শুধু ম্রো জনগোষ্ঠী নয়, বহু বন্যপ্রাণের অস্তিত্বকেই বারবার হুমকির মুখে ফেলছে।
সংরক্ষিত পবিত্র পাড়াবন বিনষ্ট করায় ম্রোরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযোগ পাওয়ার পর লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন এবং ডলুঝিরি রেঞ্জ কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বন বিভাগ। আশা করি, তদন্ত প্রতিবেদনটি পাবলিক হবে। জোরজবরদস্তি করে ম্রো বসতির গাছ কাটা বন্ধ হবে। হাতিকে বন্দি করে গাছ টানানোর মতো নির্দয় কাজ বন্ধ হবে। লেমুপালং পাড়াবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। সরই পাহাড়ে ফুটবে ক্লো-পাও। নির্ভয়ে ফুল কুড়াতে যাবে ম্রো ছেলেমেয়েরা। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মিলবে চানক্রানের ক্লোবং নাচ।
প্রসঙ্গত, এই সরই পাহাড়েরই রেংয়েনপাড়ায় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি গভীর রাতে অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল। অভিযোগ উঠেছিল, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি ম্রোদের ৪০০ একর পাহাড়ি অঞ্চল জবরদখলের জন্যই এসব ঘটাচ্ছে। এরও আগে ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল সরই পাহাড়ে আগুন লাগানো হয়েছিল। একদিকে রাবার কোম্পানির আগুন, আরেকদিকে প্রভাবশালীর কাঠ বাণিজ্য– কোনো বাহাদুরিই থামছে না সরই পাহাড়ে! কাঠ বা কোম্পানি নয়; রাষ্ট্রকে জনগণের জানমাল সুরক্ষায় সোচ্চার হতে হবে।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com