সহযোগিতা
ব্রিকসে বাংলাদেশ, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের প্যাকেজ

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ব্রিকসের সভাপতি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী সিরিল রামাফোসার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সাবিহা সুলতানা
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
ব্রিকস হলো উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অর্থনৈতিক জোট। জোটটির বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে উচ্চাশা রয়েছে। কারণ, এ জোটে বিশ্বে জনসংখ্যায় সর্ববৃহৎ দুটি দেশ চীন ও ভারত, সাবেক পরাশক্তি রাশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের মতে, বৈশ্বিক জিডিপির ৩১ শতাংশ এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এ দেশগুলোর। ভৌগোলিকভাবে দূরে অবস্থান এবং দেশগুলোর রাজনৈতিক কাঠামোর ভিন্নতা সত্ত্বেও এ জোটের সম্ভাবনা সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
১৪ জুন জেনেভায় প্যালেস ডি নেশনসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ব্রিকসে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরপরই জেনেভায় প্রেস ব্রিফিংয়ে আগামী আগস্টে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হতে যাচ্ছে– এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই ব্রিকসের সদস্য হতে চাচ্ছে। ২০২১ সালে ব্রিকসের নিজস্ব ব্যাংক ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এ যোগ দেয় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিকস জোটে যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এ জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটবে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। এ জোট থেকে বাংলাদেশের বড় ধরনের বিনিয়োগ ও ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে চলমান টানাপোড়েনের ফলে ঋণের ওপর তৈরি হওয়া শর্তের বোঝাকে পাশ কাটিয়ে ব্রিকসের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে লেনদেন, ঋণ গ্রহণ, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। ব্রিকস মুদ্রা চালু হলে এটি বিশ্ববাজারে ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে সক্ষম হবে। ফলে চলমান ডলার সংকট মোকাবিলা এবং নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ পরিশোধের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সহজে ব্রিকস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়ার ব্রিকসে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। আরও ১৯টি দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্রিকস জোট সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে এবং পারস্পরিক সহায়তা বৃদ্ধি পাবে। ফলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে। সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে এবং নানা সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে ব্রিকস দেশগুলোর প্রভাব থাকায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রভাবও বাড়বে।
তবে ব্রিকসের সদস্য হলে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে ব্রিকসে যোগ দিলে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটতে পারে। পড়তে পারে নানা নিষেধাজ্ঞায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার এবং বিনিয়োগ সহযোগী। ব্রিকসে যোগদানের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর রোষানলে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ব্রিকসের বেগ পেতে হবে, যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরে পড়তে পারে। ব্রিকসে ভারত ও চীনের প্রাধান্য এবং পশ্চিমাদের মিত্র দেশগুলোর একে একে যোগ দিতে চাওয়ার প্রবণতা পশ্চিমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জ্বালানি তেল উৎপাদন বৃদ্ধির অনুরোধ সৌদি আরবের প্রত্যাখ্যান এবং বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কের বৈরিতাকে ইঙ্গিত করে।
তা ছাড়া ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলির কারণেও বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। জোট সদস্য চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব এবং দেশগুলোর ঐকমত্যের অভাব জোটের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দেশ দুটির প্রতিবেশী হিসেবে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চাপের মুখে পড়তে হতে পারে।
ব্রিকসে যোগ দিলে সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে নিরপেক্ষ সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ব্রিকসে বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
সাবিহা সুলতানা: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- সহযোগিতা
- সাবিহা সুলতানা