জন্মদিন
শুভ জন্মদিন, সৈয়দ হাসান ইমাম

হামিম কামাল
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
কেউ কেউ আসেন যেন সময়ের সন্তান হয়ে। পরিপাশ তাদের তৈরি করার আগে সময়ই যেন পরিপাশের মাপ বুঝে তাদের নিয়ে আসে। তারা কোথাও আলোড়ন তুলতে না চাইলে কী হবে, প্রকৃতি স্বয়ং তাদের অপেক্ষায় থাকে। তারা আসবেন, ঢেউ উঠবে, বাঁধ পড়বে ভেঙে।
সৈয়দ হাসান ইমাম শৈশবে মা-খালাদের শাড়ি টাঙিয়ে মঞ্চ বানিয়ে অভিনয়ে নেমে পড়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকেই দেখব আমরা একের পর গণমুখী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরোধাদের মাঝে; তৎকালীন পাকিস্তানে চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন হিসেবে (১৯৬৫), স্বাধিকারের লড়াইয়ে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও যোদ্ধা শিল্পীদের সারিতে (১৯৬৯-৭১)। অতঃপর মানবতা ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আন্দোলনে অবিরত সৈনিক হিসেবে। শেষতক তাঁকে দেখব একজন তাত্ত্বিক হিসেবে, যিনি ললিত ভাষায় সেক্যুলার সংস্কৃতির যৌক্তিকতা বাতলে দিচ্ছেন এই ভাষায়– ‘মানুষের কল্যাণের জন্যে যে সংস্কৃতি তা প্রগতিশীল সংস্কৃতি।’ (বিবিসি, ২৬ এপ্রিল ২০১৭)
সৈয়দ হাসান ইমাম সারাজীবন রাজনৈতিক থেকেছেন। তাঁর ভাষ্যে, সবার আগে তিনি যে মানুষ। মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী এবং তার একটি মুহূর্তও অপরাপর মানুষকে জড়িয়ে যে বর্তমান, তাকে উপেক্ষা করে সামনে এগোতে পারে না। একই সঙ্গে পেছানোরও সুযোগ নেই। মানুষের রাজনৈতিকতা উপেক্ষা করেননি বলেই চিরকাল বিপ্লবী ভূমিকায় তাঁকে কখনও বিপক্ষ, কখনও স্ব-অক্ষের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হয়েছে; কখনও সদলে, কখনও একা।
তিনি মাকে মাত্র ২১ বছর বয়সে সাদা শাড়ি জড়াতে দেখেছেন। সেদিন পরিবারের সংকট বোঝার মতো বয়স তাঁর না হলেও বুকের ভেতর যে শিখা সেদিন জ্বলেছিল, তা পরবর্তী সময়ে, পরিবার আর বৃহত্তর পরিবার তথা দেশকে, আরও বৃহত্তর পরিধি তথা পৃথিবীকে বাদ দিয়ে শুধু নিজের জন্য তিনি কখনও চিন্তার পথ দেখায়নি।
হাসান ইমামের সাংস্কৃতিক বিপ্লবী জীবন আমাদের সাদা চোখের অনেক আড়ালে থেকে প্রগতির পথ কেটে দিয়েছে, যে পধে আমরা হেঁটেছি। তাঁর অভিনয় জীবন সাধারণ আমাদের সর্বাগ্রে মনে আসে। সম্ভবত অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার তাঁর সেটি নয়, যেটি তিনি ১৯৬৫ সালে সিরিয়াস অভিনয় জীবনের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলেন। বরং সবচেয়ে বড় পুরস্কার সেটি, যেটি বাংলা একাডেমির বটতলায় ১৯৬৯-এ মঞ্চায়িত ‘রক্তকরবী’র অভিনেতা ও গায়ক হিসেবে হাজার হাজার দর্শকের ভালোবাসার মধ্য দিয়ে পেয়েছিলেন। সেদিন তিনি তাদের ভেতর স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের পতনের বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। রাজার বিরুদ্ধে মানুষের যে প্রতিরোধ এবং তার বিপরীতে রাজার যে অনিবার্য পতন, তার মঞ্চায়ন সেদিন পাকিস্তানি শাসনের বিপক্ষে শক্তি সঞ্চার করেছিল। তবে রাজনীতিসচেতন শিল্পীজীবনে তার চেয়ে বেশি গ্লানি হয়তো বোধ করেছিলেন যখন গণআদালতের মাধ্যমে স্বাধীন দেশে মানবতা-স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় চারবার তাঁকে হত্যাচেষ্টা করা হয় (২০০১)।
যে জীবন হাসান ইমাম যাপন করেছেন, তার স্বীকৃতি রাষ্ট্র প্রদত্ত একুশে পদকে, স্বাধীনতা পদকের চেয়েও বেশি স্বীকৃত মানুষের হৃদয়ে তাঁর নামে যে অনুরণন জাগে, তাতে।
সৈয়দ হাসান ইমাম তাঁর যুগান্তে, এই নতুন যুগে এসে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে মানবকল্যাণের পথে; অপরাজনীতির বিরুদ্ধে জয়লাভের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখতে পান, যেখানে মানুষকে একা করে দেওয়ার পথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি দেখতে পান, লগ্নিকারীদের অধিকারে চলে যাচ্ছে যাবতীয় সৃষ্টিশীলতা। তিনি মানুষের দৃষ্টি আবারও মানবিক ঐক্যে, কল্যাণমুখী কৃত্যের ঐক্যের দিকে ফেরাতে চাওয়ার লক্ষ্যে, ইঙ্গিতে এসব জড়তা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।
উত্তর প্রজন্মের সদস্য হিসেবে, ২৭ জুলাই তাঁর ৮৮তম জন্মদিনে আমরা সেই সবুজ আহ্বান আরও দূরান্তে পৌঁছে দেব– এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
হামিম কামাল: সাংবাদিক
- বিষয় :
- জন্মদিন
- হামিম কামাল
- সৈয়দ হাসান ইমাম