তত্ত্বাবধায়ক সরকার
গভীর খাদে পাকিস্তান

জাহিদ হুসাইন
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩ | ০৫:৩০
পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হতে তিন সপ্তাহও বাকি নেই। সেখানে আসন্ন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসহাক দারের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁর নাম নির্বাচনী আলোচনায় চমকপ্রদ মোচড় নিয়ে এসেছে। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম ঘোষণা করেনি। তবে এ পদের জন্য দলটির শীর্ষ নেতারা তাঁর ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। তাঁর নাম যেভাবে এসেছে, এর পেছনে নিশ্চয় উদ্দেশ্য রয়েছে।
ইসহাক দার পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নওয়াজ শরিফের আত্মীয় এবং আস্থাভাজন। জটিল নির্বাচনী তরী পার করাতে তাঁকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও পরীক্ষামূলক এ প্রস্তাবনা হালে পানি পায়নি। দলের মধ্যেই জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় তাঁর বিরুদ্ধে কথা উঠেছে। পাকিস্তান জোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি দলও প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে। বিতর্ক কিন্তু এখনও থামেনি। পিএমএল-এন নেতৃত্ব তথাকথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ঝুঁকি নিতে নারাজ। ইসহাক দার নাটক তারই বহিঃপ্রকাশ।
নির্বাচনে ইতিবাচক ফল লাভের আশায় পিএমএল-এন বিশ্বস্ত কাউকে বসাতে চায়। সেখানে ইসহাক দারের সম্ভাবনা যদি না-ও থাকে, কিন্তু পরিকল্পনাটি এখনও রয়েছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোট অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রধান হিসেবে রাজনীতিক কাউকে বসানোর ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছে। তার মানে সেখানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কিংবা টেকনোক্র্যাট কাউকে প্রধান হিসেবে বসানো হলে ঐতিহ্যের বিদায়ঘণ্টা বাজবে পুরোপুরিভাবে। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে বসানোর উদ্দেশ্য এটা দেখানো– ভোট পরিচালনায় তারা নিরপেক্ষ।
এখন পাশা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। ক্ষমতাসীন জোটের লক্ষ্য, নির্বাচনে সাফল্যের পথে যে কোনো কাঁটা দূর করা।
ক্ষমতাসীন জোটই দৃশ্যত সর্বেসর্বা। বিরোধী দলের কোনো পাতি নেতার সঙ্গে হয়তো তারা লোক দেখানো পরামর্শ করবে। এমনকি কেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে, তা সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি রাজবংশই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জানা গেছে, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথরেখা নির্ধারণে দ্বিতীয় দফা আলোচনার জন্য তারা আবার দুবাইতে মিলিত হয়েছে। না দেশে, না কোনো নির্বাচিত ফোরামে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে। ভিন্ন দেশে শক্তিশালী কিছু ব্যক্তি বসে দেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করবেন– এ কেমন কথা!
বর্তমান আইন অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব কেবল নির্বাচন তদারকি করা। তারা নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অথচ এমনকি যেসব দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই, সেখানেও নির্বাচনের সময় বিদ্যমান সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকে সীমিত। নীতিগত বিষয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সিদ্ধান্ত নেন। নতুন আইন প্রণয়ন এবং ভঙ্গুর এই সংসদে তা পাস করানোর পদক্ষেপের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে।
পাকিস্তান সরকার বলছে, দেশ এখন সংকটে। অর্থনীতি সবল নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরি কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্তিশালী প্রশাসন দরকার। এ বড় অদ্ভুত যুক্তি। এর মাধ্যমে হয়তো প্যান্ডোরার বাক্স থেকে নতুন গল্প বেরোবে। নীতিগত সিদ্ধান্ত দুই মাস পর নিলেও কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু সরকার যেভাবে যুক্তি দিচ্ছে, সেখানে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতাসীন জোট পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআইকে ধ্বংস করার খেলায় অংশীদার। বস্তুত তারা যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই উপহাস করছে। এখন মনে হচ্ছে, তারা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নির্বাচনে লড়তে বাধা দেবে। এটা কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে না। জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সাইডলাইনে রাখার এ চেষ্টা কখনোই কাজে দেবে না।
এখন যা ঘটছে, তারও পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে পরিকল্পনার দায় তাদের তাড়া করবে। পক্ষপাতমূলক তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনে কলঙ্কিত নির্বাচন পরিস্থিতি আরও অশান্ত করে তুলবে। পাকিস্তান এমনিতেই অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ বিভক্ত হচ্ছে।
নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, দুঃখজনকভাবে সেই নির্বাচনের ফলে দেশ আরও গভীর বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হতে পারে। কলঙ্কিত এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি জনআস্থা আরও হারাবে। কর্তৃত্ববাদকে শক্তিশালী করবে। ক্ষমতাসীনরা দেশকে অচেনা সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে নিয়ে যাচ্ছে।
জাহিদ হুসাইন: পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক; ডন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- বিষয় :
- তত্ত্বাবধায়ক সরকার
- জাহিদ হুসাইন