ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

অর্থনীতি

ডলারের প্রভাব কমলে এশিয়ার সুযোগ বাড়বে

ডলারের প্রভাব কমলে এশিয়ার সুযোগ বাড়বে

নাইজেল গ্রিন

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

বৈশ্বিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ফিচ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার সর্বোচ্চ ক্রেডিট রেটিং ‘ট্রিপল এ’ তথা এএএ থেকে নামিয়ে সংস্থাটি এএ‍+ করেছে। ফিচের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, আগামী তিন বছরে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটবে। ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ আটকে দেওয়ার বিতর্ক সরকারকে তার বিল পরিশোধের ঝুঁকিতে ফেলবে। স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস-এর রেটিংয়ের পর ফিচ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, যারা যুক্তরাষ্ট্রের রেটিং ট্রিপল এ থেকে কমিয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ডলারের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে।

 ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু ফলবে, এমন কথা নেই। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবতার কাছাকাছি পৌঁছা যায়। ইতিহাসের চরম শিক্ষা হলো, কিছুই স্থায়ী নয়। এর আগেও বৈশ্বিক মুদ্রার উত্থান ও পতন উভয়ই হয়েছে। ভবিষ্যতেও এমনটি ঘটা স্বাভাবিক। তারই আলোকে আমি মনে করি, বিশ্বে ডলারের আধিপত্য কমতে শুরু করছে। ডলারকেন্দ্রিক অথনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এর অন্য কারণও স্পষ্ট। রেকর্ড ঋণের বোঝা বহন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ঋণের কারণে দেশটি ব্যাপকভাবে ডলার ছাপাচ্ছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে মুদ্রার অবমূল্যায়নের একটি কারণ হতে পারে।

এই বছরের শুরুতে ডলারের আধিপত্যের হুমকির বিষয়টি যে ক’জন সামনে নিয়ে এসেছে, আমি তাদের অন্যতম। আমি পর্যবেক্ষণে বলেছি, রাশিয়া ও সৌদি আরব তেলের ব্যবসার লেনদেনে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের কথা ভাবছে। তার মানে, ডলারের অধিপত্য শঙ্কার মধ্যে পড়বে। এর কারণ, বিশ্বে জ্বালানি তেল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রচলিত বাণিজ্যিক পণ্য। এখন তেলের মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে ডলার দিয়ে এবং এর ব্যবসায়িক লেনদেনও হচ্ছে এ মুদ্রার মাধ্যমে। ঠিক এ কারণেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজারে মার্কিন ডলারের আধিপত্য এত বেশি। কোনো দেশ অন্য দেশ থেকে তেল কিনতে গেলে তাকে মার্কিন ডলারের দ্বারস্থ হতে হয়। এখন যদি তেলের এই ব্যবসা ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা দিয়ে করা সম্ভব হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে কমবে ডলারের মূল্য ও প্রভাব।

ডলারের আধিপত্য কমে গেলে তার ইতিবাচক প্রভাব এশিয়ার অর্থনীতিতে দেখা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, এশিয়া মহাদেশে বিশ্বের সবেচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এ অঞ্চল বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমলে এশিয়ার দেশগুলো তাতে লাভবান হবে। এর মাধ্যমে তাদের মুদ্রানীতিতে এক ধরনের নমনীয়তা আসবে।

বর্তমানে চীনসহ এশিয়ার অনেক দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের পদক্ষেপ বিবেচনায় নিতে হয়। নিজেদের সুদের হার, মুদ্রানীতিসহ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে ফেডারেল রিজার্ভের প্রভাব থাকে। ডলারের ওপর তাদের অত্যধিক নির্ভরশীলতা অসুবিধাজনক। নির্ভরশীলতা কম হলে তারা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে সুবিধাজনক পদক্ষেপ নিতে পারে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য এটি সহায়ক।

ডলার পথ হারালে এশিয়ার দেশগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বৈচিত্র্য আসবে। এটি বৃহত্তর আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ আরও বাড়াবে। বহুমাত্রিক মুদ্রা পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে আঞ্চলিক মুদ্রাগুলোর ব্যবহার বাড়বে। জাপানের ইয়েন, চীনের ইউয়ান, ভারতীয় রুপি ইত্যাদি মুদ্রা প্রচলিত হলে এশিয়ার মধ্যকার ব্যবসা সহজ ও দক্ষ হবে। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার হবে। পাশাপাশি একটি আধিপত্যবাদী মুদ্রার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়, সেগুলো থেকে রেহাই পাবে।

ডলরের মূল্য ওঠানামার কারণে এশিয়ার দেশগুলোকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। বাণিজ্যিক ভারসাম্য ও পুঁজির প্রবাহের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ডলারের এমন আধিপত্য কমলে মুদ্রা বিনিময় হারে অধিক স্থিতিশীলতা আসবে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কমবে। তাতে এশিয়ার দেশগুলো আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করতে পারবে। এর মাধ্যমে পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে এবং স্থিতিশীলতা আসবে।

অধিকন্তু ডলারের আধিপত্য বজায় থাকলে এশিয়ার দেশগুলোকে বড় আকারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে হয়। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে ডলারেই এই রিজার্ভ রাখতে হয়। এর একটি অপরচুনিটি কস্ট বা সুযোগ ব্যয়ও রয়েছে। অথচ সেই রিজার্ভ দিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যেত অথবা অন্য মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করা যেত।

মার্কিন ডলারের প্রভাব কমে গেলে এশিয়ার দেশগুলো তাদের রিজার্ভ ধরে রাখার বিষয়টি আরও বৈচিত্র্যময় করতে পারে। অর্থাৎ তারা সম্পদের ভালো ব্যবহার করতে পারে এবং তা উৎপাদন খাতে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করতে পারে। আমি প্রত্যাশা করি, পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ও বহুমেরুর বিশ্ব হবে। এর মাধ্যমে আরও বৈচিত্র্য ও ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি হবে। এশিয়ার গতিশীল অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

নাইজেল গ্রিন: অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডিভেরির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা; এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×