ঢাকা শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

আন্তর্জাতিক

মধ্য এশিয়াই নতুন বৃহৎ খেলার মূল যুদ্ধক্ষেত্র

মধ্য এশিয়াই নতুন বৃহৎ খেলার মূল যুদ্ধক্ষেত্র

পেপে এসকোবার

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩ | ০৬:১২

বিশ্বের এক সময়ের অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থান উজবেকিস্তানের সমরকন্দ বা সেন্ট্রাল ইউরেশিয়া এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরস্পর কৌশলগত অংশীদারিত্বে যুক্ত চীন-রাশিয়ার মধ্যে চলমান বৃহৎ খেলার প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতেও তা এ রকম থাকবে।

গ্রেট গেম বা বৃহৎ খেলাটি হয়েছিল ১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে। বাস্তবে এটি কখনোই বন্ধ হয়নি; শুধু সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া বনাম ইঙ্গ-মার্কিন এবং পরবর্তীকালে মার্কিন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন বনাম রাশিয়ার খেলায় পরিণত হয়েছিল।

১৯০৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের জন্য ম্যাকিন্ডার-পরিকল্পিত ভূ-রাজনৈতিক খেলার নকশা অনুসারে এ অঞ্চলটিই ছিল সেই প্রবাদপ্রতিম ‘ইতিহাসের পিভট বা মূল খুঁটি’; কয়েক শতক আগের মতো ২১ শতকেও উদীয়মান বহুকেন্দ্রিকতা সৃষ্টির মূল চালক হিসেবে এর পুনরুজ্জীবিত ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রাসঙ্গিক।

সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, সব বৃহৎ শক্তি সমরকন্দ বা সেন্ট্রাল ইউরেশিয়াতে কাজ করছে: চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ভারত, ইরান, তুরস্ক এবং কিছুটা কম পরিমাণে জাপান। মধ্য এশিয়ার পাঁচটির মধ্যে চারটি দেশ, যাদের নামের শেষে স্তান যুক্ত– সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) পূর্ণ সদস্য: কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান এবং কাজাখস্তানের মতো কয়েকটি দেশ শিগগিরই ব্রিকস প্লাস-এর সদস্য হতে পারে। এ অঞ্চলজুড়ে প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্ট মূল প্রত্যক্ষ ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষটি অগণিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে।

এ ক্ষমতার খেলা দেখার জন্য সমরকন্দের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক জায়গা বর্তমানে নেই, যাকে এক সময় ‘প্রাচ্যের রোম’ বলা হতো। এটাই ছিল প্রাচীন সোগদিয়ানার কেন্দ্রীয় এলাকা– চীন, ভারত, পার্থিয়া এবং পারস্যের মধ্যে সংঘটিত বাণিজ্যের ঐতিহাসিক সংযোগস্থল। এখানেই মিলিত হয়েছে পূর্ব-পশ্চিম সাংস্কৃতিক ধারাগুলো, জরথুস্ট্রিয়ানিজম এবং প্রাক/উত্তর-ইসলামিক ভেক্টরগুলো। চতুর্থ শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত সোগদিয়ানরাই পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে একচেটিয়াভাবে রেশম, তুলা, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, অস্ত্রশস্ত্র, সুগন্ধি, পশম, কার্পেট, জামাকাপড় ইত্যাদির কাফেলা বাণিজ্য চালায়। উইলি সোগদিয়ান বণিকরা যাযাবর রাজবংশের কাছ থেকে সুরক্ষা নিয়ে চীন এবং বাইজেন্টিয়ামের মধ্যে বাণিজ্যকে শক্তিশালী করে।

মেধাবী চীনা এলিটরা এ বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। আনুষ্ঠানিকভাবে বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) নামে পরিচিত,  নয়া সিল্ক রোড ধারণার পেছনে এটিই মূল চালকরূপে কাজ করেছে, যা প্রায় ১০ বছর আগে কাজাখস্তানের আস্তানায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা করেছিলেন। এর মাধ্যমে বেইজিং প্যান-ইউরেশিয়ান বাণিজ্য এবং সংযোগ বৃদ্ধির জন্য তার পশ্চিমা প্রতিবেশীদের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ করার পরিকল্পনা করেছে। এ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চায় গুরুত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বেইজিং এবং মস্কোর মনোভাব পরস্পরের পরিপূরক। উভয়েই সর্বদা কৌশলগত সহযোগিতার নীতি মেনে চলছে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এসসিও হলো রাশিয়া-চীনের সাধারণ কৌশলের একটি প্রকৃত ফসল এবং সেই সঙ্গে ইউরেশিয়ার সঙ্গে অবিরাম সংলাপের একটি প্ল্যাটফর্ম।

নামের শেষে ‘স্তান’যুক্ত সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশগুলো বিভিন্নভাবে এ উদ্যোগে সাড়া দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ– তাজিকিস্তান, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর এবং সস্তা শ্রম সরবরাহকারী হিসেবে রাশিয়ান বাজারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ্চাত্যসহ সবার সহযোগিতা পেতে একটি ‘খোলা দুয়ার’ নীতি মেনে চলে। কাজাখস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত অংশীদারি পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছে (তাদের শেষ বৈঠকটি গত বছরের শেষের দিকে হয়েছিল)। উজবেকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বের সংলাপ’ রয়েছে, যা ২০২১ সালের শেষের দিকে স্থাপিত।

এক দশক আগে চীনা বিআরআইর সূচনার সময় থেকে ইইউ ওই অঞ্চলজুড়ে প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে: খুব খারাপ নয় (মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ)। তবে এখনও এ বিষয়ে চীনা প্রতিশ্রুতির নিচে।

এদিকে পুরো অঞ্চলে মূল ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রাধান্যে থাকা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাশিয়ান ভাষা রয়ে গেছে। কাজাখস্তান রাশিয়ার সঙ্গে সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের অংশীদার (এখন কোনো সীমান্ত বিরোধ নেই)। কাজাখস্তান নিজেকে ইউরেশিয়ান হিসেবে দেখে। গত বছর পুতিন বেশ কিছুদিনের জন্য প্রথমবারের মতো পাঁচটি মধ্য এশিয়ার ‘স্তান’ অনুসর্গযুক্ত রাষ্ট্র সফর করেন। চীনকে মাথায় রেখে তারা প্রথমবারের মতো ৫‍+১ শীর্ষ সম্মেলনও করেছে।

এ পরিস্থিতিতে এবং একটি নতুন বৃহৎ খেলার প্রেক্ষাপটে যা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ইউরেশিয়া অঞ্চলের কিছু কূটনৈতিক গোষ্ঠী ব্রিকস প্লাসের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রচনায় খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনে এটি নিয়ে আলোচনা হতে বাধ্য। কৌশলগত সূত্রটি দাঁড়ায় রাশিয়া + মধ্য এশিয়া + দক্ষিণ এশিয়া + আফ্রিকা + লাতিন আমেরিকা, যাকে লুকাশেঙ্কো বলছেন ‘গ্লোবাল গ্লোব’-­এর আরেকটি উদাহরণ। প্রক্রিয়াটা শুরু হতে পারে কাজাখস্তান ব্রিকস প্লাসের সদস্য হিসেবে গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

এর পর সব বিশ্ব হয়ে উঠবে পরিবহন, রসদ, শক্তি, বাণিজ্য, উৎপাদন, বিনিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবিত ইউরেশিয়ার প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ। এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, এ মঞ্চের প্রেরণা হবে নতুন ও পুরোনো সিল্ক রোড– ‘মানুষের সাথে মানুষের বিনিময়’।

পেপ এসকোবার: ইউরেশিয়াবিষয়ক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক; দি ক্রেডল থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন

আরও পড়ুন

×