ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

মিমস যোগাযোগ

ঘটনা রাজপথে, লড়াই অনলাইনে

ঘটনা রাজপথে, লড়াই অনলাইনে

রাজীব নন্দী

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩ | ০৬:১২

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা ‘ফাটাকেষ্ট’ দেখেছেন অনেকেই। নায়ক মিঠুনের মুখে সেই বিখ্যাত সংলাপ– ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’। বাংলাদেশের রাজনীতির হয়েছে সেই ফাটাকেষ্ট দশা। এখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির নির্বাচনী উত্তাপের রঙ্গমঞ্চে নায়করা মারবে রাজপথে, কিন্তু কমেন্ট পড়বে টপাটপ অনলাইনে, অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক যোগাযোগের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মিমস বড় ধরনের প্রভাব রাখতে যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে বাংলাদেশিদের তেমন বিচরণ নেই। তবে এ মুহূর্তে হঠাৎ টুইটারে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ হুহু করে বেড়ে গেছে। ফেসবুকে মিম ও পাল্টা মিমের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন ও লোডশেডিং নিয়ে একে অপরের ওপর ভার্চুয়াল আক্রমণ চালিয়েছিল দল দুটি (সূত্র: দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২ আগস্ট ২০২৩)। জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশে যখন জোরেশোরে লোডশেডিং চলছিল, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক তুমুল হাস্যরসাত্মক লড়াই দেখেছিলেন নেটিজেনরা। ফেসবুকে মিম ও পাল্টা মিমের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন ও লোডশেডিং নিয়ে একে অপরের ওপর ভার্চুয়াল আক্রমণ চালিয়েছিল দল দুটি।

সমসাময়িক গণমাধ্যমে মিমস একটি কেন্দ্রীয় মনোযোগের বিষয়। এক সময় ছোটগল্প, চুটকি, কৌতুক, কার্টুন, ক্যারিকেচার– এসব কনটেন্ট ‘কমিউনিকেশন টুলস’ হিসেবে কাজ করলেও এখন মিমস হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। কেন ও কীভাবে এই মিমস মানুষের যোগাযোগের কেন্দ্রীয় জগতে প্রভাব বিস্তার করে, তা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহার করেন ৫ কোটি ৯২ লাখ, ইনস্টাগ্রাম ৬৫ লাখ এবং লিঙ্কডইন ৭০ লাখ। আর ২০২৩ সালের শুরুর দিকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১০ লাখ ৫০ হাজার।

রাজনৈতিক যোগাযোগে মিমের ভূমিকা বেশ শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময়ে মিমসের নাম শুনেছেন বা দেখেছেন। মিডিয়ার এই আধেয়টি আজ ইন্টারনেটে বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মিমস বলতে– যা কোনো পরিস্থিতি, অবস্থা, ব্যক্তি, ঘটনা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে রসিকতা করে। মিমস সাধারণত অনলাইনে একজন থেকে আরেকজনের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা রাখে, যেখানে সেটির প্রতিলিপি বা পুনরাবৃত্তি হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হয়। নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যে মিম তৈরি হয় না। মিম প্রস্তুতকারক এবং ভোক্তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। তাদের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি জানার মধ্য দিয়ে একটি মিমের অতীতকে কীভাবে বর্তমানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে, তা বুঝতে সহায়ক হয়।

বাংলাদেশে মিমস এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয় একটি আধেয়। একটি মিম ছবি, ভিডিও, অডিও বা জিআইএফ ফরম্যাটের হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, মিমস সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। মিমস ভোক্তা এবং প্রস্তুতকারকের মধ্যে কারও কাছে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়; কারও কাছে এটি বিরক্তির। কোনো কোনো সময় ভোক্তা কর্তৃক নতুন একটি লাইন জুড়ে দিয়ে মিমস শেয়ার করার মাধ্যমে এটি নতুন মাত্রা পেয়ে থাকে।

তবে মিম হাস্যরসাত্মক কনটেন্ট হলেও তার ভূমিকা রাজনৈতিক হতে পারে। বিশেষত যেসব সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, সেখানে মিম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রে কার্টুনের যে ভূমিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিম যেন সেই ভূমিকা নিয়েছে। বাংলাদেশকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হাস্যরসের আশ্রয়ে মিম এক রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউব। এই প্ল্যাটফর্মগুলো যোগাযোগ, বিনোদন, তথ্য আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সমর্থন জোগাড় করে। ফেসবুকে শেয়ার করা মিমস কখনও কখনও ট্রলে পরিণত হয়। এতে সাধারণ মিমস আর সাধারণ থাকছে না; ট্রল নামক একটি ভার্চুয়াল আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

মানুষের মনের ভাব কথা বা লিখিত আকারে যা বলা যায় না, তা মিমসের মাধ্যমে তুলে ধরা যাচ্ছে। পলিটিক্যাল কমিউনিকেশনে সংবাদপত্রে এক সময় কার্টুনের যে ভূমিকা ছিল, আজ সেই জায়গা নিয়েছে মিমস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা জনপরিসর হিসেবে কাজ করছে মিমস। মিমস এখন ব্যঙ্গ-কৌতুকের ডিজিটাল মহাফেজখানা। এখানে সিরিয়াস লোকজনের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ‘মিমস’ তথা রসিকতার ছলে সমসাময়িক ইস্যুকে অ্যাড্রেস করতে এখন পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন খুবই শক্তিশালী। ব্যঙ্গ সাহিত্যের অসাধারণ লেখক আবুল মনসুর আহমদ, কালপেঁচা (বিনয় ঘোষ), শিব্রাম চক্রবর্তী, পরশুরাম কিংবা মুজতবা আলীর ব্যঙ্গ, রঙ্গ, রসিকতা, শ্লেষ, ঠাট্টা, বিদ্রুপ, ভাঁড়ামি, ফাজলামি– এ সবই কৌতুক-রসের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজিতে যাকে আমরা উইট বা হিউমার বলি, তার আরেক নাম স্যাটায়ার বা ক্যারিকেচার এসব শ্রেণিভুক্ত। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মিমস সেই জায়গা দখল করেছে। মিমস এখন ডিজিটাল কমিউনিকেশনের শক্তিশালী একটি কনটেন্ট। মাত্রাগত মতপার্থক্য থাকলেও হাস্য বা পরিমাণগত পার্থক্যকে কিছুটা দূরে রেখে সিরিয়াসগোত্রীয় শ্রেণিগত শ্রোতা-দর্শকবৃন্দ এখানে ভুল বোঝাবুঝির শিকার/স্বীকার হতে পারেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রাণশক্তি নেওয়ার জন্য এখানে আছে রস। আর জানেন তো, বাঙালির রস ছাড়া রসিকতা হতে পারে না। তবে রস যাতে পরিমিত হয়, গড়িয়ে না পড়ে; সে জন্য সজাগ থাকাও বড় কর্তব্য বটে!

রাজীব নন্দী: সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
rajibnandy@cu.ac.bd

আরও পড়ুন

×