অন্যদৃষ্টি
মন্ত্রী গরিবের অর্থনীতি বোঝেন?

মিজান শাজাহান
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
বাজারের ব্যাগ হাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেকের মুখে হতাশার ছাপ দেখা যায়। অর্থমন্ত্রী যতই অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের সমালোচনা করুন না কেন, বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। ‘যারা বলছেন দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, তারা অর্থনীতিই বোঝেন না’– অর্থমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে বিস্মিত হচ্ছি না। আমাদের দেশের মন্ত্রীরা মাঝে মধ্যে ‘স্লিপ অব টাং’ করে বসেন। একজন বাণিজ্যমন্ত্রী কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারদলীয় প্রবীণ আইনপ্রণেতা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওই মন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ‘কম খান’ কথাটি ওই সময় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল।
বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিকবার সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেছেন, ওখানে হাত দেওয়া যাবে না, তাহলে বাজারে আরও বড় সংকট তৈরি হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যখন সিন্ডিকেটে হাত দিতে দশবার চিন্তা করেন তখন বুঝতে হবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক কারা। সেই নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রী কেন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না? দেশের অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতি না-ও বুঝতে পারেন। সাধারণ মানুষ সংসার চালাবার জ্বালাটা হাড়ে-মাংসে বোঝেন। বোঝেন না কেবল অর্থমন্ত্রী।
সাধারণ মানুষ অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, দিনমজুর অর্থনীতির কেতাবি ভাষা বোঝেন না। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির পার্থক্য নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়েও মাথা ঘামান না এসব মেহনতি মানুষ। পেট ভরে তিনবেলা খেতে আর শান্তিতে ঘুমাতে পারলেই নিম্নবিত্ত খুশি। তারা বোঝেন, দিনে আট ঘণ্টা মেহনত করে ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার করবেন। ২০০-২৫০ টাকার বাজারে তিনবেলা বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে পেট ভরে খাবেন। বাকি টাকায় ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসা, বছরে তিনবার পোশাক কেনা হয়ে যাবে। পোলাও-কোরমা খাওয়ার অভিলাষ তাদের নেই। ২০০-২৫০ টাকায় চার সদস্যের সংসারের চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংস কি পাওয়া যাবে? চুলা জ্বলতে আগুন লাগে। আগুন জ্বালাতে লাকড়ি কিনতেই মাসে দরকার হাজার দুয়েক টাকা। মাছ-মাংস এখন পোলাও-কোরমার মতো মৌসুমি খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছে কারও কারও কাছে।
সরকার এক কোটি পরিবারের মাঝে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেও অনেক নিম্নবিত্ত সুবিধা পাচ্ছেন। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতাসহ সরকারের একাধিক প্রকল্প অবশ্যই গরিবের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাজার যে ঊর্ধ্বমুখী তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু ডাবের বাজারে সিন্ডিকেটের থাবা দেখিয়ে দিল যুদ্ধকে ঢাল বানিয়ে মুনাফালোভীরা ঠিকই পকেট ভারী করছে।
রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা,/ তা না হলে মানচিত্র খাবো’-এর কথা সবার মনে আছে। সরকারের মন্ত্রীরা যতই বলুন না খেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে না; অনেকের যে নুন আনতে পান্তা ফুরায়– এটি অস্বীকার করা যাবে না। এক কোটি পরিবারকে সরকার সুবিধা দিচ্ছে। এটি কম কথা নয়। কিন্তু আয় বাড়েনি, খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। তাই সার্বিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে অর্থমন্ত্রীর অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতি বোঝা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বড়ই বেমানান। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর নয়, বাণিজ্যমন্ত্রীর। বিভাজন না করে বললে, দায়িত্বটা সরকারের। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় আর সিন্ডিকেটের থাবা ভাঙতে পারলে বাজারে গিয়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়ানো ক্রেতার মুখের কালো মেঘ কাটলেও কাটতে পারে।
মিজান শাজাহান: সহসম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- মিজান শাজাহান