ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক

ব্রিকস সম্প্রসারণ ভারতকে যে সংকটে ফেলল

ব্রিকস সম্প্রসারণ ভারতকে যে সংকটে ফেলল

মার্ক এস কোগান

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদীয়মান অর্থনীতির ব্রিকস ব্লক বিশ্বপরিসরে তাদের প্রভাব বাড়াতে সম্মত হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ব্লকটির নতুন সদস্য করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি এই উদীয়মান অঞ্চলের সম্ভাব্য নেতা ভারতের বিদেশনীতির বড় ভুল হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে নিজের শক্তি সীমিত থাকলেও তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে বাড়তি ক্ষমতা যোগ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন, ভারতের জন্য ব্রিকস উপকারই বয়ে এনেছে। কারণ একটি বহুজাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা হিসেবে এটি বেইজিং ও নয়াদিল্লি উভয়ের জন্য রাজনৈতিক কোনো ঝামেলা ছাড়া ধীরস্থিরভাবে সংলাপের সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি ২০১৭ সালের ডোকলাম অচলাবস্থা এবং বর্তমানের লাদাখ সংকটের মতো নিরাপত্তা ইস্যু থাকার পরও এটা বলা যায়। তবে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) বা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক)-এর মতো অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে যুক্ত হয়ে ভারত সুস্পষ্টভাবে লাভবান হলেও ব্রিকস সম্প্রসারণ দেশটির জন্য সুবিধার বদলে ঝুঁকিই তৈরি করেছে। নতুন সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে চীনের শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে। ফলে ব্রিকসে চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে ইরানকে আরও বেশি করে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। ফলে চীনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বেশ মজবুত অবস্থায়। শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক ইরানের জ্বালানি খাত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোরদার করায় কেন্দ্রীভূত। দুই বছর আগে ইরান ও চীন ৪০০ বিলিয়ন ডলারের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটা ইরানকে চীনের মহাপ্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভে যুক্ত করবে। চুক্তিটি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বাড়িয়ে দেওয়ায় বেইজিংও বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। চীন মার্কিন নিষেধাজ্ঞাধীন ইরানি তেলের প্রধান ক্রেতা; তেহরানের সঙ্গে তার এমন সম্পর্ক বহুদিনের।

চীন ইরানের তেল রপ্তানিকে স্বাগত জানায়। একই সঙ্গে সে ইরানি তেলের ওপর পাশ্চাত্যের দেওয়া বিধিনিষেধের সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ইরানের দেওয়া মূল্যহ্রাসের সুবিধা পাচ্ছে। এই দুই সুবিধার কারণে চীন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে ইরানি তেল পায়। চীন এ সুবিধা নিতে পারছে কারণ সে নিষেধাজ্ঞাধীন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করার পরিণামজনিত ঝুঁকির তোয়াক্কা করে না। ব্রিকসের মধ্য দিয়ে ইরানিদের সহায়তা করতে গিয়ে চীন-ইরান সম্পর্ক পরের স্তরে উঠে গেছে। সেটি তেল বা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা বিকাশে সাহায্য ছাপিয়ে গেছে। ইরান ভারত বা ব্রাজিলের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দ্রুত বুঝতে পেরেছে যে ভারত ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককে একটুও টোল খেতে দিতে রাজি নয়।

তেহরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও জ্বালানি চাহিদা এবং ইরানের ভূকৌশলগত অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। তবে এটি ভারতের ওপর ততটা নির্ভর করে না, যতটা করে ইরানের ওপরে। জ্বালানির কথা বাদ দিলে ভারতকে উদ্বিগ্ন করার মতো অনেক কিছু আছে সেখানে। ভারতের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও চীন ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নে একটি চুক্তি করতে বহু পরিশ্রম করেছে। কারণ তাদের ভয় চীন যদি পাকিস্তানের গদর বন্দরের পর এখানেও পা ফেলে তাহলে তা ভারতের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। ব্রিকস ছাতার মধ্যে ইরানকে নিয়ে এসে শি চীন-ইরান সহযোগিতার পালে নতুন হাওয়া দিলেন। এর ফলে ইরান অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসারও সুযোগ পাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা দুর্বল হয়ে পড়বে। এটি পশ্চিম এশিয়ায় দ্বিতীয় কোয়াড তৈরির ভারতীয় প্রচেষ্টাকেও জটিল করে তুলবে। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের এ নতুন উপস্থিতি ভারতের জন্য অবশ্যই চিন্তার কারণ হবে।

ব্রিকসে ইরানের প্রবেশ অন্যান্য ক্ষুদ্র এবং বহুপক্ষীয় ফোরামেও ভারতের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। যদিও ওপেকের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো ব্রিকসে আসায় ভারতও চাইলে তা থেকে ফায়দা তুলতে পারে। একই সঙ্গে এ ঝুঁকিও রয়েছে যে ইরান ও সৌদি আরব রাশিয়া-চীনের সঙ্গে মিলিত হয়ে পশ্চিমাবিরোধী ব্লকটিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এর ফলে জি৭ ও জি২০ উভয়ের সঙ্গে ভারতের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক চর্চা কঠিন হয়ে যেতে পারে। ভারত কিন্তু বর্তমানে জি২০-এর সভাপতি। যদিও এটি কাগজে-কলমে গ্লোবাল সাউথের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও একটি কণ্ঠ দিতে পারলেও, ব্রিকস সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভাজনও বেড়ে গেল। এতে করে কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে আসা, এমনকি আপস করা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।

ব্রিকসে অন্যান্য দেশের অন্তর্ভুক্তিতে চীনের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। দেশগুলো এমন অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের প্রভাব নেই। আর্জেন্টিনাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অংশ পরিশোধে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চীন দেশটির অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও বটে। রেল এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রকল্পের জন্য চীনা ব্যাংক থেকে দেশটি ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। আর্জেন্টিনাকে ব্রিকস সদস্যপদ পেতে ব্রাজিলও ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির ওপর চীনের প্রভাবও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্রিকসের মাধ্যমে বুয়েনস আয়ার্সে বেইজিংয়ের প্রভাব বাড়বে।

এটা ঠিক, ব্রিকস সম্প্রসারণের এ প্রতিক্রিয়া আগামী বছর পর্যন্ত অনুভূত হবে না এবং মুদ্রার মূল্যায়নের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনও যতটা বলা হচ্ছে ততটা ঘটবে না। তবে ব্রিকসে ভারতের অবস্থান কমজোরি হবে। এবং রাশিয়ার সঙ্গে তার বিরূপ সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে তার কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে দিল্লির ঘাম ছুটে যাবে। একই সঙ্গে বেইজিংয়ের ব্যাপক প্রভাবাধীন একটি
জোটে নিজের প্রভাব বজায় রাখাও তার জন্য  কঠিন হবে।

মার্ক এস কোগান: জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী শিক্ষক। জিওপলিটিক্যাল মনিটর ডটকম থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন

আরও পড়ুন

×