দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে তখন সরকারের পক্ষ থেকে 'সারাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ' চিহ্নিত করে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বস্তুত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কিছু ছিল না বরং পুরোনো নির্দেশনাই নতুন করে কঠোরভাবে মানার জন্য বলা হয়েছে। ঘরে থাকা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা যেতে বিধিনিষেধ আরোপ এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বের হতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্যমে করোনা পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে- সে বার্তাই আমরা পাচ্ছি। আমরা দেখেছি, বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় যখন সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয় এবং ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তখনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রামক রোগ আইন, ২০১৮ এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে আরোপিত বিধিনিষেধ ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্নিষ্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। আমরাও মনে করি, এ পরিস্থিতিতে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

এমনিতেই এখন দেশের প্রায় অর্ধেকাংশে 'লকডাউন' চলছে। ভাইরাসের বিস্তার রোধে আলাদাভাবে অধিকাংশ জেলা, উপজেলা, অঞ্চল লকডাউন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সারাদেশে যান চলাচল কার্যত বন্ধ; চলছে সাধারণ ছুটি। এর মধ্যেও সরকার নির্দেশিত সবচেয়ে বড় যে সতর্কতা- ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা; সেটি সর্বত্র পালনে সন্তোষজনক চিত্র আমরা দেখছি না। দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ যেমন জরুরি প্রয়োজনে বের হচ্ছে তেমনি অপ্রয়োজনেও বের হওয়ার চিত্র স্পষ্ট। শহরের মানুষ যতটা সতর্কতা অবলম্বন করছে, মফস্বল ও প্রত্যন্ত গ্রামে ততটাই ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। এটা সত্য যে, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় দেশের সর্বত্র সচেতনতা এসেছে। দোকানপাট খোলার ব্যাপারেও বিধিনিষেধ কার্যকর হয়েছে।

তবে এখনও দুটি বিষয় প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলছে। প্রথমত, ত্রাণের জন্য গরিব-অসহায় মানুষের বাইরে বেরিয়ে আসা। আবার ত্রাণ বিতরণ কাজেও মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। শুক্রবারের সমকালে এক ভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ, ত্রাণের দাবিতে দেশের কয়েকটি স্থানে মহাসড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। মুখ চিনে ত্রাণ দেওয়ার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে কোথাও কোথাও। অথচ প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়ের সময় বলেছেন, দলীয় পরিচয় দেখে ত্রাণ বিতরণ নয়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোনো শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা ঘর থেকে বের হয়ে এসে আন্দোলন করছে। ক্ষুধার্ত মানুষ ঘর থেকে বেরোতে বাধ্য হচ্ছে। ত্রাণ কার্যক্রম এ সময় জরুরি- তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু করোনা ঝুঁকির কারণে ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক অভাবী মানুষের তালিকা করে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আমরা জানি, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউন, ঘরে অবস্থান ও চলাচলে বিধিনিষেধ কেবল আমাদের দেশেই নয়, বরং ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়ছে গোটা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভাইরাসটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানও করোনা পরিস্থিতি কঠোরভাবে মোকাবিলা করছে। এ অবস্থায় আমাদেরও কঠোর হতে হবে। আমাদের প্রতিদিন যেভাবে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে; যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা; সেটি আরও বাড়াতে যেন আমরা ভূমিকা পালন না করি। বরং ঘরে অবস্থান করে সতর্কতার মাধ্যমেই আমাদের জতীয় দায়িত্ব পালিত হবে। আমরা দেখছি, প্রতিদিনই নতুন নতুন জেলা ও অঞ্চল সংক্রমণের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। কোথাও হয়তো একজন থেকেই পুরো এলাকা ছড়িয়েছে। এলাকা থেকে উপজেলা, জেলায়ও প্রভাব পড়েছে। ফলে সতর্কতার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তিই গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারাদেশকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে বলে ঘরের বাইরে কোথাও আমরা নিজেদের ঝুঁকিমুক্ত বা নিরাপদ মনে করতে পারি না। এখানে গ্রাম-শহর সব একাকার। আমরা চাই, প্রত্যেকের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। কেবল নিজের কিংবা পরিবারের ঝুঁকি নয়, বরং গোটা দেশের ঝুঁকির কথা চিন্তা করেই আমরা ঘরে থাকি। ঘরে থেকেই দেশের জন্য কাজ করি। আমরা যদি স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব ঘরে থেকেই পালন করতে পারি, তাহলে স্বাভাবিক নির্দেশিত আরও কিছুদিন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারব না কেন? ঝুঁকিপূর্ণ এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। একেবারে কঠোর না হয়ে মানুষকে বুঝিয়ে বিধিনিষেধ মানাতে হবে। প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই বড় বিপর্যয় থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।

বিষয় : ঝুঁকিপূর্ণ সারাদেশ

মন্তব্য করুন