তথ্য গোপন করার যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিরূপ প্রভাব থাকে, জরুরি অবস্থা বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তা হয়ে ওঠে গুরুতর। করোনাভাইরাসের মতো সর্বব্যাপ্ত পরিস্থিতিতে তথ্য গোপন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। একজনের অসত্য তথ্য একশ'জনের জীবনহানির কারণ হতে পারে। যে কারণে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা এ ব্যাপারে একাধিকবার সতর্কতা ব্যক্ত করেছি। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি যে, তা সত্ত্বেও করোনাভাইরাস নিয়ে তথ্য গোপন থেমে নেই। অস্বীকার করা যাবে না, করোনা নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে লুকোচুরির সামাজিক কারণ রয়েছে। আমরা দেখেছি, প্রবাসী বা বিদেশফেরত মাত্রই করোনা পরিস্থিতিতে দেশে এসে বহুমাত্রিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত হওয়া দূরে থাক, এমনকি আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহবশত খোদ পরিবারের সদস্যরা কতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে, স্বামী ও সন্তানরা এক নারীকে মধুপুর জঙ্গলে ফেলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে। স্ত্রী ও সন্তানও অক্ষম গৃহকর্তাকে সাভারে ফাঁকা বাড়িতে রেখে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার খবর দেখেছি আমরা। এমনকি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর খোদ হাসপাতালে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার অঘটনও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এমতাবস্থায় কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য লুকানোর মতো অসচেতন অবস্থান গ্রহণ করে, তাতে অবাক হওয়ার অবকাশ সামান্য।

আমাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, নিছক অসচেতন মানুষ নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ধাক্কা খেতে খেতে মুখ লুকাতে অভ্যস্ত নিম্নবিত্ত নয়; খোদ চিকিৎসক করোনাভাইরাস নিয়ে যা করেছেন, তা যতখানি না অসচেতনতা তার চেয়ে অনেক বেশি অপরাধ। শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালের একজন সহকারী অধ্যাপক করোনার লক্ষণ নিয়েও হাসপাতালে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পরে যখন করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে দিয়েছেন, তখন ব্যবহার করেছেন এমন একটি ঠিকানা, যেখানে তিনি থাকেন না। ফলে তার কর্মস্থল ্তুলকডাউন সম্ভব হলেও আবাসিক ভবনটির জন্য একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। ইতোমধ্যে তার সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী অন্তত তিনজন সংক্রমিত হয়েছেন। ওই চিকিৎসক রাজধানীর আরও ডজন দুয়েক হাসপাতালের আইসিইউ পরামর্শক। সেখানে তার সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কী অবস্থা, আমরা জানি না। আমরা জানি না, এই চিকিৎসক ও তার সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেসব রোগীর চিকিৎসা করেছেন, তাদের কী পরিস্থিতি। আমরা মনে করি, তথ্য গোপন করে তিনি কেবল অমার্জনীয় অপরাধ করেননি; চিকিৎসক পেশারও অপূরণীয় অসম্মান করেছেন। আমরা আশা করি, তিনি ও তার সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত সবাই সেরে উঠবেন। কিন্তু তারও আগে তার বর্তমান ঠিকানা খুঁজে বের করে লকডাউন করতেই হবে। তার সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং রোগীদের সবাইকে শনাক্ত করে নিতে হবে উপযুক্ত ব্যবস্থা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না।

মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তথ্য গোপন ত্রিমাত্রিক অপরাধের জন্ম দেয়। এতে করে প্রথমত করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তার রোধের কাজটি কঠিন হয়ে পড়ে। এখনও টিকা বা ওষুধ আবিস্কৃত না হওয়া এই ভাইরাস রোধের একমাত্র উপায় আক্রান্তদের শনাক্ত করে সঙ্গনিরোধ বা চিকিৎসা। কিন্তু তথ্য গোপনের কারণে যদি আক্রান্তরা চিহ্নিতই না হয়, তাহলে কাকে চিকিৎসা, আর কাকে সঙ্গনিরোধ! জেনেশুনে তথ্য গোপনের দ্বিতীয় অপরাধ হচ্ছে, এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সামষ্টিক ঝুঁকি তৈরি করেন। নিজের পাশাপাশি পরিবার ও স্বজন ছাড়াও সমাজের জন্য পরিণত হন মানবভাইরাস হিসেবে। তৃতীয়ত তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও নাজুক করে তোলেন। রোগী বা চিকিৎসক, যিনিই তথ্য গোপন করুন না কেন, ধরা পড়ার পর অনিবার্যভাবেই সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা ইউনিট লকডাউন করতে হয়। এতে করে কেবল করোনা চিকিৎসা নয়, সাধারণ রোগের চিকিৎসার পথও সংকুচিত হতে থাকে। আর লকডাউন হওয়া হাসপাতালে চলমান চিকিৎসা প্রক্রিয়া স্থানান্তর কতটা চ্যালেঞ্জের, ঢাকা শিশু হাসপাতালের তা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে কথিত আইসিইউ বিশেষজ্ঞের সৌজন্যে। সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কেবল রাজধানীতেই এমন অন্তত ১০টি হাসপাতাল ও ইউনিট বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

আমরা দেখতে চাই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে যে কোনো ধরনের লুকোচুরি বন্ধ হয়েছে। এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক কর্মসূচি যেমন চাই, তেমনি চাই কেউ করোনা আক্রান্ত হলে সামাজিক হেনস্তার অবসান। করোনাভাইরাস বিপজ্জনক সন্দেহ নেই; কিন্তু এর যে কোনো ব্যাপারে তথ্য গোপন হয়ে উঠতে পারে আরও বিপজ্জনক।