গাজায় গণহত্যা
হামাসের হামলা শূন্য থেকে ঘটেনি

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের লেখা
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:২৯
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ঘণ্টায় ঘণ্টায় আরও অবনতি হচ্ছে। গাজায় যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে এবং এটি পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে নীতিগত বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি হলো, বেসামরিক নাগরিকদের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
তবে ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষোভ হামাসের হামলার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। একই সঙ্গে এ হামলার কারণে ফিলিস্তিনি সব মানুষ সম্মিলিতভাবে শাস্তিও পেতে পারে না। যুদ্ধেরও তো নিয়ম আছে। আমাদের অবশ্যই দাবি করতে হবে– সব পক্ষ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা সম্মান করবে ও মেনে চলবে। সামরিক অভিযান পরিচালনায় বেসামরিক ব্যক্তিদের রক্ষায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবে এবং হাসপাতালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় কোনো পক্ষ ব্যাঘাত ঘটাবে না। কারণ ছয় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় আশ্রয় নিয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় যেভাবে লাগাতার বোমা বর্ষণ করছে, তাতে বেসামরিক মানুষের হতাহতের মাত্রা এবং আশপাশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। এটি গভীর উদ্বেগজনক বিষয়। গত দুই সপ্তাহে গাজায় বোমা হামলায় ইউএনআরডব্লিউএ তথা ফিলিস্তিনি শরণার্থী তদারককারী জাতিসংঘ সংস্থার হয়ে কাজ করা কয়েক ডজন সহকর্মীর প্রাণহানিতে আমি একদিকে শোকাহত, অন্যদিকে তাদের জীবন ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। দুঃখজনকভাবে তাদের হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। আমি তাদের পরিবারের কাছে ঋণী। আমি তাদের ও অন্যদের ওপর পরিচালিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই।
যে কোনো সশস্ত্র সংঘাতে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের রক্ষা করার অর্থ কখনোই তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা নয়। বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা করা মানে এই নয় যে, ১০ লক্ষাধিক মানুষকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া। সেখানে কোনো আশ্রয় নেই, খাদ্য নেই, পানীয় নেই; নেই ওষুধ ও জ্বালানি। এর পর সেই দক্ষিণেও বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট যে লঙ্ঘন আমরা প্রত্যক্ষ করছি, আমি তার জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। স্পষ্ট করে বলতে চাই, সশস্ত্র সংঘাতে থাকা কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সৌভাগ্যবশত অবশেষে কিছু মানবিক ত্রাণ গাজায় ঢুকছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় এতই সামান্য যে সেটা সিন্ধুর মধ্যে বিন্দু মাত্র। উপরন্তু গাজায় আমাদের জাতিসংঘের জ্বালানি সরবরাহ কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তেমনটি ঘটলে আরেকটি বিপর্যয় ঘটবে। জ্বালানি ছাড়া সাহায্য পৌঁছানো যাবে না। হাসপাতালে বিদ্যুৎ থাকবে না এবং খাবার বিশুদ্ধ করা যাবে না। এমনকি পাম্পও চালু করা যাবে না। গাজার মানুষের যে চাহিদা, সে জন্য ব্যাপকভাবে সাহায্য বিতরণ করা প্রয়োজন। এ সাহায্য কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের কাছে পৌঁছানো জরুরি।
জাতিসংঘে আমার সহকর্মী ও সেই মানবিক তৎপরতার অংশীদারদের অভিবাদন জানাই, যারা এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গাজায় কাজ করছেন। এমনকি যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে গিয়ে নিজেদের জীবনকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন। এই মানবিক কর্মীরা আমাদের প্রেরণা।
আার আহ্বান, ট্রাজিক এই দুর্দশা কমাতে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা সহজতর ও নিরাপদ করুন। জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে কাজ করুন। অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য আমার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করছি। এমনকি গুরুতর ও ভয়ানক বিপদের এই মুহূর্তে আমরা সত্যিকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতার একমাত্র বাস্তববাদী সমাধানের বিষয়টি দূরে সরাতে পারি না; সেটি হচ্ছে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান।
ইসরায়েলিদের নিরাপত্তার জন্য তাদের দাবি যেমন মানতে হবে, তেমনি ফিলিস্তিনিদেরও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি বাস্তবায়ন করা জরুরি। এটি জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং আগের চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পরিশেষে মানব মর্যাদা সমুন্নত রাখার নীতি অবশ্যই আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে হবে। ব্যাপক ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি মেরূকরণ ও অমানবিক আচরণে ইন্ধন দিচ্ছে। আমাদের অবশ্যই ইহুদিবিদ্বেষ, মুসলিমবিরোধী ধর্মান্ধতা এবং সব ধরনের ঘৃণার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আজ ২৪ অক্টোবর; জাতিসংঘ দিবস। জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হওয়ার ৭৮ বছর হলো। এই সনদে শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় আমাদের সামষ্টিক অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়। সংকটময় সময়ে এবারের জাতিসংঘ দিবসে আমি সবাইকে আহ্বান জানাই– সহিংসতায় আরও প্রাণ যাওয়া এবং যুদ্ধ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমরা যেন এই পথ থেকে সরে দাঁড়াই।
আন্তোনিও গুতেরেস: জাতিসংঘ মহাসচিব; ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বক্তব্য; আইপিএস নিউজ এজেন্সি থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক