ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

তৃতীয় মেরু

চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে জামায়াতের ‘মার্ক টাইম’

চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে জামায়াতের ‘মার্ক টাইম’

শেখ রোকন

শেখ রোকন

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:৩০ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৩:১০

আমরা পছন্দ করি বা না করি, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছে। আমরা দেখেছি, জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যায় তৃতীয় অবস্থানে থেকেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনী জোট গঠনে জামায়াতে ইসলামী হয়ে উঠেছিল ‘গেইম চেঞ্জার’। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি এবং ২০১৪ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার নেপথ্যেও ‘জামায়াত ফ্যাক্টর’ কাজ করেছিল। এটাও সত্য, ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপির জোট শরিক হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার মাশুলও জামায়াতকে কম দিতে হয়নি। 

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে ২০১০ সালে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতারা আটক হতে থাকলে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছিল দলটি। বিনাবাধায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে মারধর ছাড়া কোনো কর্মসূচিও পালন করতে পারছিল না। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে দলটির নিবন্ধনও উচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি ঝুলে থাকতে থাকতেই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।

নির্মোহভাবে দেখলে, রাজনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের নির্বাচন যদি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো না হয়; ভোট ও জোটের বাজারে আরও একবার ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে যাচ্ছে দলটি।
প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন কার্যত মুখোমুখি; নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই যখন ভোট ও জোটের বাজারের লাভক্ষতির অঙ্ক কষছে; তখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আসলে কী করতে চাইছে?

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনা বা কৌশল সম্পর্কে কমবেশি জানা গেলেও ‘ক্যাডারভিত্তিক’ জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় অসম্ভব। যদি না খোদ জামায়াতের পক্ষ থেকেই ‘কৌশলগত কারণে’ কোনো তথ্য ‘লিক’ করা হয়। দলীয় নির্দেশনার প্রতি নেতাকর্মীর নিঃশর্ত আনুগত্যই একমাত্র কারণ নয়; কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বের স্তরগুলোর কর্মপরিকল্পনার মধ্যে দুর্ভেদ্য দেয়ালের কারণেও এক স্তরের খবর অপর স্তর জানতে পারে না।

রাজনৈতিক কর্মসূচি বিবেচনা করে যদি পরিস্থিতি বুঝতে চাই, প্রায় এক যুগের বেশি কোণঠাসা অবস্থায় থাকার পর গত ১০ জুন পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করতে পেরেছিল। ওই সমাবেশের পর ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার গুঞ্জন তৈরি হয়। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকেন। অন্যদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য দিতে থাকেন। (আগ্রহীরা পড়ুন, আওয়ামী লীগের গাজর এবং জামায়াতের দাঁত/ শেখ রোকন/ সমকাল, ১১ জুন ২০২৩)।

এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি-জামায়াতের প্রায় আড়াই দশক প্রাচীন রাজনৈতিক জোট দৃশ্যত ভেঙে যায়। ওই মাসেই জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এবং তার আগের সেপ্টেম্বরে সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আটক হন এবং এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে জামায়াতের ক্ষোভ জন্মানের কথা বলা হলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনাও অবদান রাখতে পারে। পরে বিএনপির ‘যুগপৎ আন্দোলন’ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী ‘পৃথকভাবে অভিন্ন কর্মসূচি’ পালন করলেও দুই পক্ষের প্রকাশ্য সহাবস্থান আর দেখা যায়নি। 

এরপর এই ২৮ অক্টোবর এসে ঢাকা ‘সমাবেশের শহর’ হয়ে উঠলে, তখন জামায়াতে ইসলামীও আরামবাগ মোড়ে সমাবেশ করল। এই ধারণা অমূলক হতে পারে না যে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে এসেছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা ও তাগিদ তত বেড়েছে। অনেক দিন পর গত ১০ অক্টোবর জামায়াতের নেতারা অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। এরপর জামায়াত বলতে গেলে তাদের ‘সাবেক’ বড় শরিকের কর্মসূচিরই প্রতিধ্বনি করে যাচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। জামায়াতও ওইদিন হরতাল ডাকে। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে ওই সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার জামায়াতও অবরোধ ঘোষণা করেছিল। আবার আগামী রবি ও সোমবারও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াত।

খোলাচোখে দেখলে, বিএনপির মতোই বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে জামায়াত। আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল কারাগারে থাকায় বর্তমানে শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমানও বলেছেন, ‘আওয়মী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। কেয়ারটোর সরকার ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। জীবন দিয়ে হলেও প্রতিরোধ করব।’ (সমকাল, ২৯ অক্টোবর ২০২৩)। কিন্তু তাতে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয় না যে, বিএনপির ‘অনুমতিপ্রাপ্ত’ মহসমাবেশ পণ্ড হয়ে গেলেও জামায়াতের ‘অনুমতিহীন’ সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হতে পারল কীভাবে?

বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়া নিয়ে আধা কিলোমিটার দূরত্বে যখন সংঘর্ষ চলছে, তখন জামায়াতের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ দিয়ে এই সমাপনী বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ– ‘কোনো উস্কানিতে পা দেবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে চলে যাবেন।’

বিদ্যমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টতই চৌরাস্তা মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দলটির সামনে তিনটি পথ খোলা। একদিকে রয়েছে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন; জামায়াতের আদর্শ, পরম্পরা ও রাজনৈতিক পুঁজির দিক থেকে সেটাই সবচেয়ে সহজ। কিন্তু যদি বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি আবার সরকার গঠন করে; তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত জামায়াতকে আরও এক মেয়াদে চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। 

দ্বিতীয় পথে রয়েছে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। তাহলে আপিলে ঝুলে থাকা নিবন্ধন ফের কোঁচড়ে এসে পড়তে পারে। গত ১০ জুন বা ২৮ অক্টোবরের মতো বাধাহীন কর্মসূচি পালনের সুযোগও মিলতে পারে। বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটার সমর্থন বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আদর্শিক ও ঐতিহ্যগত ভোটব্যাংকের বড় অংশ হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে।

গত দেড় দশকে সরকারের দিক থেকে জামায়াত যে ‘ট্রিটমেন্ট’ পেয়ে এসেছে, সে কারণেও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা কঠিনই। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, যাবজ্জীবন বা গ্রেপ্তার শুধু নয়; দলটির তৃণমূলেরও অনেক নেতাকর্মী এখন কারাগারে। মাত্র ২৭ অক্টোবর থেকেই, জামায়াতের ১ হাজার ২৮৪ জন নেতাকর্মী আটক বা গ্রেপ্তার হয়েছে। (সমকাল, ৩ নভেম্বর ২০২৩)।

তৃতীয় পথ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সরাসরি নির্বাচনের বদলে মিসরের ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি বা তুরস্কের একে পার্টির মতো বেনামি রাজনৈতিক সংগঠনকে পরিস্থিতিমতো নির্বাচনে নামানো। এই লক্ষ্যে এরই মধ্যে নিবন্ধন পাওয়া ও নিবন্ধন চাওয়া একাধিক ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলকে জামায়াত প্রস্তুত রেখেছে বলে কানাঘুষা রয়েছে।

অবশ্য জামায়াত কী করবে, সেটা জামায়াতই ভালো জানে। তবে পরিস্থিতি জটিল ও কঠিন; এমন পরিস্থিতিতে যে কোনও দলের জন্যই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। আমার ধারণা, দলটি এখনই কোনো পথে যাওয়ার বদলে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ‘মার্ক টাইম’ করছে। সামরিক প্রশিক্ষণে এর অর্থ হচ্ছে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মার্চ করতে থাকা। জামায়াতে ইসলামী সম্ভবত উপযুক্ত পরিবেশের জন্য অপেক্ষায় সেটাই করছে। যাতে করে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে সামনের তিন পথের যে কোনো একটিতে প্রবেশ করা যায়। 

শেখ রোকন: লেখক ও গবেষক; সহযোগী সম্পাদক, সমকাল 
skrokon@gmail.com

আরও পড়ুন