যারা রম্যের নন, তারা প্রণম্যও নন
ক্ষমতা

মনোয়ার রুবেল
মনোয়ার রুবেল
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ০৮:২৬ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৫:৪১
রেলেওয়ের এক লাইনম্যান সদ্য বিয়ে করেছেন। শালিদের কাছে গল্প করছিলেন, তিনি হাত তুললেই রেল থেমে যায়। শালিরা চোখ কপালে তুলে বললেন, বাব্বাহ!
শালিদের দাবি মেনে দুলাভাই তাদের নিয়ে গেলেন তাঁর অসীম ক্ষমতা দেখাতে। তিনি হাত দিয়ে লাল পতাকা তুললেন। ট্রেন থেমে গেল। হঠাৎ ট্রেন থামায় যাত্রীরা হইহই রইরই করে নেমে জানলেন সদ্য বিবাহিত এক লাইনম্যান শালিদের নিজের ক্ষমতা দেখাতে ট্রেন থামিয়েছেন। সব শুনে যাত্রীরা লাইনম্যানকে ধরে ধোলাই দিলেন।
শালিদের জিজ্ঞাসার উত্তরে দুলাভাই উত্তর দিলেন, আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম। তারা তাদের ক্ষমতা দেখাবেন না? শালিরা জানলেন আম জনতার হাতেও অল্প বিস্তর ক্ষমতা আছে।
প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশের জনগণের কি এমন ক্ষমতা দেখানোর উপায় আছে? অতীতে কখনও-সখনও রাস্তার ঝাড়ুদারও এমপির বেপরোয়া গাড়ি দেখে বলতে পারতেন, ‘ভোটের সময় দেখমু আপনার ক্ষমতা, আইসেন তখন’। এখন সেই সুযোগ কি আছে?
বুদ্ধিজীবীরা বলছেন– না, নাই।
আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা যখন-তখন রেগে যান। তাই তাদের নিয়ে লেখালেখিও এখন যথেষ্ট ঝুঁকির। এ অবস্থা কিছুটা ষাটের দশকের জার্মানির মতো।
পূর্ব জার্মানির স্তালিনবাদী নেতা ওয়াল্টার উলব্রিখট এবং বামপন্থি সাংবাদিক উইলি ব্র্যান্ডটের দেখা। উলব্রিখট জিজ্ঞেস করলেন– ‘তুমি এখন কী নিয়ে ব্যস্ত।’
ব্র্যান্ডট উত্তর দেন, ‘আমি নিজের সম্পর্কে রসিকতা সংগ্রহ করি। এবং আপনি?’
উলব্রিখট উত্তর দেন, ‘আমি এমন লোকদের তথ্য সংগ্রহ করি, যারা আমার সম্পর্কে রসিকতা করেন!’
বাংলাদেশে এ টাইপ গল্প বলে রসিকতা করাও দায়। এখানে আপনি একদল জাতীয়তাবাদী পাবেন যারা বলবে, আপনি সরকার বা দলের বদনাম করছেন। একই সঙ্গে তারা দাবি করবেন তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করেন না। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী বিরোধী দলেও রয়েছে। ফলে বুদ্ধিজীবীদের জন্য দু’পক্ষের নেতা ও কর্মীই শাঁখের করাতসম।
একজন আমেরিকান এবং একজন রাশিয়ান কোন দেশে বেশি বাকস্বাধীনতা আছে তা নিয়ে তর্ক করছেন। আমেরিকান বলেছেন, ‘‘আমি সরাসরি হোয়াইট হাউস পর্যন্ত যাব এবং চিৎকার করে বলব ‘জো বাইডেন নিপাত যাক!’ আমার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটবে না। রাশিয়ান ভদ্রলোক উত্তর দিলেন– ‘আমিও ক্রেমলিন পর্যন্ত যাব। এবং আমারও চিৎকার করে বলার স্বাধীনতা আছে ‘জো বাইডেন নিপাত যাক!’ আমারও কিছুই হবে না।
এসব গল্প রাষ্ট্রভেদে সর্বজনীন। রম্যলেখকগণ যখন স্বদেশে চাপা আতঙ্কবোধ করেন রাষ্ট্রের নাম তখন পালটে দেন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার বলছে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ক্রমাবনতি হচ্ছে। তবে এটি বাঙালির জন্য আদৌ চিন্তার বিষয় না। কারণ– তেল, চাল, ডাল বহুবিধ বিষয় নিয়ে এত বেশি ভাবতে হচ্ছে যে, সংসার চালানোর চিন্তাই আমাদের আপাত বড় সমস্যা। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য বাকস্বাধীনতা বিলাসিতা।
৯জন ইউরোপিয়ান রাজনীতিবিদের সঙ্গে একমাত্র বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ গেলেন হিমালয় জয় করতে। পাহাড়ে ওঠার সময় ভীষণ বিপদে পড়ে গেলেন দশ অভিযাত্রী। বেয়ে ওঠার দড়িটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। যেকোনো একজনকে দড়ি থেকে ফেলে না দিলে সবাই একসঙ্গে পড়ে যাবেন এমন অবস্থা। কেউই হাত থেকে দড়ি ছাড়তে নারাজ। বাংলাদেশি মন্ত্রী দেখলেন পরিস্থিতি বেশি সুবিধার না। তারা ৯ জন মিলে তাঁকে হাত থেকে দড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করবেন।
তখন তিনি সবার উদ্দেশে বক্তৃতা শুরু করলেন, কেন তাদের মতো মহান পণ্ডিতদের জীবন তাঁর মতো তুচ্ছ মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান এবং তিনি এই ৯ জন ইউরোপিয়ান রাজনীতিবিদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারছেন বলে কেমন ধন্য বোধ করছেন তাও বললেন। পণ্ডিতেরা তাঁর বক্তৃতায় আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। সবাই আবেগে হাততালি দিয়ে উঠলেন। এরপর শুধু তিনি টিকে রইলেন। রাজনীতিতে নিজে টিকে থাকাই আসল কথা। মাঝে মধ্যে এমনও হয়, অন্যরা এসে আপনাকে টিকে থাকতে দেবে না, উৎখাত করতে চাইবে। তখন রাগ হতে পারে, কী দোষে তারা সরকার উৎখাত করতে চাচ্ছে!
এটি মূলত একটি ইউরোপিয়ান গল্প। ইউরোপ, আমেরিকায় এমপি, মন্ত্রী রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে হাস্যরস করা উচ্চমাত্রার রসিকতা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হচ্ছে না! অথচ বছর কিছু আগেও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে পত্রিকায় কার্টুন আঁকা হতো, সমালোচনাও হতো। নমস্য কার্টুনিস্ট রফিকুন্নবী (রনবী) কার্টুন এঁকেছেন, শিশির ভট্টাচার্য্য এঁকেছেন, মানিক রতন এঁকেছেন। পত্রিকায় এ সময় প্রচুর রাজনতৈকি রম্য লেখা হতো। মানুষ মজা পেতো। এ আনন্দ সব দেশের রাজনীতিবিদরা উপভোগ করেন। আমাদের দেশে নেতারা কী মনে করেন জানি না, কিন্তু ফেসবুকে একটি মজার জোকস লিখলেও তার নিচে শত শত আক্রমণাত্মক মন্তব্য পড়ে এখন। আমরা কি দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
পত্রিকায় কার্টুন কৌতুক রম্য কিন্তু ব্র্যান্ডিংয়েরও বিষয়। কার্টুন বা রম্য তাঁকে নিয়েই লেখা হয়, যিনি তুমুল জনপ্রিয়। রাজনীতি সচেতন বাঙালির রাজনীতিবিদগণও সম্ভবত রাজনীতির ক, খ, গ ভুলে গিয়েছেন। তাদের আবার রাজনীতির উদারতা, রাজনীতির রসরসিকতা শেখাবে কে? রাজনীতি শেখার কোনো স্কুল নেই।
এক তরুণ এসেছেন হাতেকলমে রাজনীতি শিখতে। নেতা তাঁকে বাড়ির ছাদে নিয়ে বললেন, লাফ দে।
তরুণ বলল, ‘কী বলছেন এসব! এখান থেকে লাফ দিলে ছাতু হয়ে যাব।’
‘নিচে জাল পাতা আছে। কিচ্ছু হবে না। লাফ দাও।’
তরুণটি নেতার কথায় বিশ্বাস করে লাফ দিলেন। যথারীতি হাত-পা ভেঙে চ্যাংদোলা হয়ে পড়ে রইলেন।
নেতা নিচে নেমে এলেন।
‘আপনিতো বলেছিলেন কিছুই হবে না।’
নেতা বললেন, ‘এটা তোমার প্রথম শিক্ষা। রাজনীতিতে কখনও কোনো নেতাকে বিশ্বাস করবে না।’
তরুণটি রাজনীতি শিখে গেলো।
তিনি হয়তো আগামী নির্বাচনেও দাঁড়াবেন! আমরা সাধারণ মানুষও নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়। প্রতিবারই আমরা ভোট দেই, বিশ্বাস করি, আছাড় খাই। আবার ভুলে যাই এসব। সব ভুলে হাসি-আনন্দে রসরসিকতায় মেতে উঠি।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
monowarrubel@gmail.com