হামাসের পথেই চলছে গাজা যুদ্ধ
ফিলিস্তিন
.
স্কট রিটার
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:২৬ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:২৬
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ নিয়ে তাঁর সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বহুল প্রত্যাশিত বক্তৃতা দিয়েছেন। নাসরাল্লাহর সেই বক্তৃতা চলাকালেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এক সংবাদ সম্মেলনে গাজা যুদ্ধ; তার ফলে সৃষ্ট ফিলিস্তিনিদের মানবিক সংকট সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব কিছু বক্তব্য এবং সংবাদকর্মীদের কিছু প্রশ্নের জবাব দেন।
অনেক পর্যবেক্ষক, যারা ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর চলমান নির্বিচার বোমাবর্ষণে বহু শিশুসহ নিরীহ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যাযজ্ঞে ক্ষুব্ধ, মনে করেছিলেন যে দীর্ঘকালব্যাপী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী ইসরায়েলের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে হিজবুল্লাহর ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়। অন্য পর্যবেক্ষকরা মনে করেছিলেন, নাসরাল্লাহ এ মুহূর্তে তেমন কিছু করতে ব্যর্থ হবেন এবং প্রমাণ করবেন, ফিলিস্তিনি জনগণ যতই প্রত্যাশা করুক, তার দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার বিষয়টি আসলে ফাঁপা বুলি।
সাধারণভাবে এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থাপনার সুর ও বিষয়বস্তু দেখলে মনে হবে, উভয়ের লক্ষ্য এক নয়। নাসরাল্লাহ বলেছেন, হিজবুল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল গাজার বিরুদ্ধে ‘আগ্রাসন বন্ধ’ এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের ‘বিজয়’ নিশ্চিত করা। এ জন্য তার সৈন্যরা লেবানন সীমান্তে সংঘর্ষের মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীর একটি অংশকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। অন্যদিকে, ব্লিংকেন হিজবুল্লাহ ও ইরানে ‘পরিস্থিতির সুবিধা নেওয়া’ এবং দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। কিন্তু একটু গভীরে তাকালে দেখা যাবে নাসরাল্লাহ ও ব্লিংকেন উভয়েই হামাস-ইসরায়েল সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ুক, তা চাননি। এ যুদ্ধ বিষয়ে নিজ নিজ দৃঢ় অবস্থানে উভয়েই অটল; কাজটা তারা করতে চান যুদ্ধ বিস্তার প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার সতর্ক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পক্ষই যেমন গাজা যুদ্ধ ঘিরে সৃষ্ট আবেগের চাপ সামাল দেওয়ার উপযুক্ত পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি সহিংসতার দ্রুত বৃদ্ধি বা অঞ্চলব্যাপী সংঘাতের বিস্তার এড়ানোরও পথ পেয়েছে। সংক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র ও হিজবুল্লাহ উভয়েই ‘এস্কেলেশন ল্যাডার’ নামে পরিচিত দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনার একটি মডেল বাস্তবায়ন করছে। যদিও এই বাস্তবতা উভয় পক্ষের সেই মানুষদের জন্য হতাশাজনক, যারা একটি নিষ্পত্তিমূলক, একতরফা বিজয় চায়, তবে যুদ্ধকে বর্তমান সীমানায় আটকে রাখতে; অন্যথায় যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়তে পারে– এটিই একমাত্র দায়িত্বশীল পথ। এ মডেলে যুদ্ধে জড়িত পক্ষগুলো একে অন্যের পদক্ষেপ দেখে কী ব্যবস্থা নেয় তার ওপর জোর দেওয়া হয়, যেগুলোকে মইয়ের বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অন্যদের ক্রিয়াকলাপ এবং সেগুলোর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি পক্ষ যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে ধারণা পায় এবং করণীয় ঠিক করতে পারে।
চলমান গাজা সংঘাতের সমস্যা হলো, এখানে অনেক পক্ষ, যাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন, কেউ চাইলে চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে একটা পক্ষ এবং হামাস-হিজবুল্লাহকে অন্য পক্ষ ভাবতে পারেন। এটাও অনস্বীকার্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে মতবিরোধ আছে যুদ্ধবিরতি, মানবিক পরিবেশ এবং নির্দিষ্ট সামরিক কৌশল নিয়ে। হামাস-হিজবুল্লাহর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, যেখানে হামাসের শুধুই ফিলিস্তিনকেন্দ্রিক ভাবনা হিজবুল্লাহর আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপের আলাদা মূল্যায়নও হামাস-হিজবুল্লাহর কৌশলকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানে অন্যান্য পক্ষ যেমন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, ইরান, ইয়েমেন এবং ইরাকি ও সিরীয় শিয়া মিলিশিয়ারা জড়িত হয়ে পড়লে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
দিনের শেষে কিন্তু এমন কোনো সমাধান অসম্ভব, যা সব পক্ষের জন্য সন্তোষজনক। ইসরায়েল সামরিক ও রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে হামাসকে ধ্বংস করতে চায়। হামাস তার ভাবনার আদলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চায়। বিজয়ের এই দুটি দর্শন পরস্পরবিরোধী। উভয় পক্ষই নিজের পছন্দের ফল পেতে এস্কেলেশন ল্যাডারটি পরিচালনা করতে চাইবে। অন্য পক্ষগুলোর মূল চাওয়া হলো, কীভাবে এই অন্তর্নিহিত অসংগতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায় এবং পরাজয়ের পাশাপাশি জয়ের ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত হয়।
এদিক থেকে অবশ্য হামাস সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। ইসরায়েল একটি ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আছে, যেখানে তার রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপগুলো সমর্থকরা ক্রমবর্ধমান হারে প্রত্যাখ্যান করছে। ব্লিংকেনের বক্তব্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের অবস্থানের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটি স্পষ্ট ছিল, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বিরোধ বর্তমান গতিপথে চললে তা বাড়বে। ইসরায়েল এ পরিস্থিতি থেকে একমাত্র তখনই বেরিয়ে আসতে পারবে, যদি চলমান যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ লাগাতে পারে। ব্লিংকেন স্পষ্ট করেছেন, বাইডেন প্রশাসন এমনটা চায় না। হাসান নাসরাল্লাহও তা চাইছেন না।
এই আলোকে নাসরাল্লাহর বক্তব্যের সামগ্রিকতা এবং তার যুক্তির জটিলতা যাচাই করতে হবে। ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের এমন কোনো দিক নেই, যা তিনি ভাষণে বলা বাদ রেখেছেন। নাসরাল্লাহর বক্তৃতায় ছিল কীভাবে একটি জটিল এস্কেলেশন ল্যাডার মডেল পরিচালনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করা যায়, তারই নির্দেশনা।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, হামাস বিজয়ের পথে রয়েছে। যদিও তা একজন সাধারণ পর্যবেক্ষকের মনমতো কোনো বিজয় নয়। হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের চূড়ান্ত ইতিহাস যখন লেখা হবে, সেখানে নিশ্চিত থাকুন– হাসান নাসরাল্লাহর ভাষণটিরও উল্লেখ থাকবে। কারণ, এটি একটি বৃহত্তর যুদ্ধ এড়িয়ে সব পক্ষকে হামাস দ্বারা সংজ্ঞায়িত মূল বিষয়গুলোতে মনোযোগ রাখতে বাধ্য করেছে; যে বিষয়গুলোর মধ্যে আছে বন্দি বিনিময়, আল আকসা মসজিদে ধর্মচর্চার স্বাধীনতা এবং ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রসত্তা। ইসরায়েলের ধ্বংস নয়, এই সীমিত উদ্দেশ্যগুলো অর্জনই চলমান সংঘাতের সম্ভাব্য ফল হতে যাচ্ছে। এর জন্য আমরা সবাই হাসান নাসরাল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে পারি; তিনি একজন ব্যক্তি, যিনি জানেন কীভাবে কার্যকরভাবে এস্কেলেশন ল্যাডার মডেলের জটিলতাগুলো বুঝে তা পরিচালনা করতে হয়।
স্কট রিটার: মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা; আরটি ডটকম থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন