ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ডিডিটি গেছে, কার্বোফুরান যাবে?

কীটনাশক

ডিডিটি গেছে, কার্বোফুরান যাবে?

.

পাভেল পার্থ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:২৭ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:২৭

সমকালীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন কী? আপাতত দুটিকে শামিল করতে চাই। চার দশক পর দেশকে সর্ববিনাশী ডিডিটি বিষমুক্ত করা গেছে। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ধ্বংস করার জন্য ডিডিটির শেষ চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। যদিও ডিডিটি দেশের কৃষকরা আমদানি বা উৎপাদন করেনি। কৃষিবিদদের ফর্দ অনুযায়ী এই বিষ কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে এসেছিল ষাটের দশকে; কথিত সবুজবিপ্লব বাস্তবায়নে। শরীরে, রক্তে, শস্যে, খাবারে, পানিতে ভয়াবহভাবে বিষ মিশে যাওয়ায় রাষ্ট্র বিষের বোতলের গায়ে ‘বিষ বিপজ্জনক’ লিখতে বাধ্য হয়। কিন্তু এখনও খাদ্য উৎপাদনে বিষ ব্যবহার বাতিল করা যায়নি। কারণ এসব নিয়ন্ত্রণ করে মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, বিএসএফ, কারগিল কিংবা ডুপনন্টের মতো জায়ান্ট। তারা দুনিয়ার কৃষিকাজ ও খাদ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের খাবারে বিষ থাকবে, নাকি মধু– এই সিদ্ধান্ত তাদের।

দ্বিতীয় অর্জনও আরেক সর্ববিনাশী বিষ নিয়ে। ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ৮৮তম দেশ হিসেবে কার্বোফুরান বিষ নিষিদ্ধ করেছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাবের কারণে এর আগে ৮৭টি দেশ এটি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু নিষিদ্ধ করেও করতে পারেনি রাষ্ট্র বিষ কোম্পানিদের বাধার কারণে। ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময় বাড়াতে হয়েছে। আশা করি, অক্টোবরের পরে আর দেশে কার্বোফুরান কোনো কোম্পানি উৎপাদন, মজুত ও বিক্রয় করছে না।

চলতি লেখাটির কারণ হলো আবারও রাষ্ট্রকে তার কার্বোফুরান নিষিদ্ধকরণের অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দেওয়া। দেশের প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ ও সংবাদমাধ্যমকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কার্বোফুরানের উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার বন্ধ হলো কিনা, সেটা এখন নজরদারি দরকার। এ জন্য সরকারের নতুন প্রকল্প গ্রহণের দরকার নেই। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আছেন; প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে। এরা কার্বোফুরানের মনিটর করতে পারেন নিজ নিজ এলাকায়। নতুন প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিয়মিত নিজের এলাকার কার্বোফুরান কোথাও পাওয়া গেলে ছবি ও তথ্যসহ জানাতে পারে। প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা সরকারের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চাই। রাষ্ট্রের চেয়ে কোম্পানি ক্ষমতাবান হতে পারে না। জনগণের শক্তির কাছে বিষ কোম্পানির লোভ পরাস্ত হবেই– ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। 

কার্বোফুরান কার্বামেট জাতীয় বালাইনাশক। মার্কিন কোম্পানি এফএমসি করপোরেশন ‘ফুরাডন’ নামে এবং জার্মান কোম্পানি বায়ার ‘কিউরেটর’ নামে এই বিষ বিক্রি করে। এটি এমনই মারাত্মক বিষ, এক চা চামচের চার ভাগের এক ভাগ পেটে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। মানুষ ছাড়াও যে কোনো প্রাণীর জন্যই এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এর এক দানা বিষ খেলে পাখি মরে যেতে পারে। পূর্বে এটি দানাদার ছিল এবং যখন জমিতে ব্যবহৃত হতো তখন না বুঝে পাখিরা এই বিষ গিলে মারা যেত। ১৯৯১ সালে পাখির মৃত্যু কমাতে দানাদার ধরনটি বাতিল করা হয়। এর বহুল ব্যবহার প্রজনন স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। হরমোন সমস্যা হয় এবং শুক্রাণু উৎপাদন কমে যায়। কার্বোফুরান কানাডা, শ্রীলঙ্কা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিষিদ্ধ। ২০০৮ সালে আমেরিকা নিষিদ্ধের ঘোষণা দেয়, এমনকি কেনিয়াও। কেনিয়াতে সিংহ মারার জন্য এটি ব্যবহারের কথা জানা যায়।  

সংবাদমাধ্যম সূত্র জানায়, দেশে এখনও বিষ কোম্পানিদের জিম্মায় ৩ হাজার ২৮৫ টন কার্বোফুরান এবং ৪৮ টন কাঁচামাল রয়েছে। এসব বিষ পরিবেশসম্মতভাবে নষ্ট করার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই; তাই বিক্রি ও ব্যবহার করেই এই বিপজ্জনক বিষ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর আগেও কয়েক দফা সরকার এটি নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিলেও কয়েকটি প্রভাবশালী বালাইনাশক কোম্পানির চাপে সরে এসেছিল। এবারও তার পুনরাবৃত্তি করতে দেওয়া যাবে না।

আরও অনেক কিছু জানার অধিকার রয়েছে জনগণের। জমিনে কার্বোফুরান প্রয়োগের পর এক থেকে দুই মাস এর বিষক্রিয়া ফসলে থেকে যায়। তার মানে কার্বোফুরান প্রয়োগকৃত ফসলের মাধ্যমে খুব সহজেই আমাদের শরীরে এই বিষ ছড়িয়ে যেতে পারে। জানা জরুরি কে, কারা এবং কোন সময়ে এই সংহারী বিষ আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল রাষ্ট্র। একের পর এক সংহারী বিষের অনুমোদন যেসব ব্যক্তি এবং কর্তৃপক্ষ দেয় তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রকাশিত হওয়া জরুরি। সংহারী বিষের মাধ্যমে দেশের বাস্তুতন্ত্র, প্রাণ-প্রকৃতিতে যে বিষক্রিয়া এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। 

আমাদের খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের অসুস্থতা। শরীর ও মনের জটিল সব অসুখে ভুগছে মানুষ। দেশের যে কোনো প্রান্তের ওষুধের দোকান আর হাসপাতালের সামনে গেলে বোঝা যায় দেশের মানুষ কেমন আছে। কেন বাড়ছে এসব অসুস্থতা। এর প্রধান কারণ আমাদের খাদ্য ও পরিবেশ মারাত্মক বিষচক্রে দূষিত। তাহলে এই দূষণ থামিয়ে আমাদের শরীর ও মনের মুক্তি মিলবে কীভাবে? রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে বিষমুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ থাকতে হবে। আশা করছি, ডিডিটির পর কার্বোফুরান সম্পূর্ণ বাতিল ও নিষিদ্ধ করে পরপর দেশকে বিপজ্জনক বিষমুক্ত করবে রাষ্ট্র। বাংলাদেশ পারবেই। বাংলাদেশ মানে দেশের মানুষ; প্রাণ-প্রকৃতি। আর এই সর্বপ্রাণের শক্তিই রাষ্ট্রের হিম্মত। এই হিম্মতের সঙ্গে কি সংহারী বিষের মুনাফা দাঁড়াতে পারে?

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×