ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

বিপর্যয়ের মুখে দেশ!

রাজনীতি

বিপর্যয়ের মুখে দেশ!

এম এ আজিজ

এম এ আজিজ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:৩৪ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:৩৪

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ সরকারি দল ‘ডান হাত’ হলে বিরোধী দল ‘বাম হাত’। কিন্তু বাংলাদেশে বহু দল থাকলেও সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে অপরের শত্রুভাবাপন্ন। দৃশ্যত মনে হয়, তারা একে অপরকে নির্মূল করতে চায়।

কারণ প্রতিটি বড় দলের মধ্যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা অনুপস্থিত। তাই সব দলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ দলগুলোর মধ্য থেকে কোনো দল জনগণের ভোটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী শাসক। এই কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতির কারণে কোনো জাতীয় সমস্যাতেও তাদের একমত হতে দেখা যায় না।

যাহোক, সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হলেও নির্বাচন কমিশনকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। চলতি মাসের প্রথমার্ধেই নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণা করবে। এই সময়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল জীবন-মরণ যুদ্ধে নেমেছে, যা গোত্রীয় যুদ্ধে পরিণত। 

এদিকে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার পাশাপাশি ডলার সংকট, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, রিজার্ভ, বিনিয়োগ ও উৎপাদনকেন্দ্রিক আমদানি, অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণসহ অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখী। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন। আয়বৈষম্য বাড়ছেই। রাজনৈতিক সংকট যদি আরও ঘনীভূত বা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে অর্থনীতিতে ধস নামতে বাধ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় ২০২২-এর জরিপে দেখা যায়, গত এক যুগে দেশে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, তেমনি দ্রুতগতিতে বেড়েছে বৈষম্য। এখন ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

আবার ধনী-দরিদ্র আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর কাছাকাছি। আয়বৈষম্য শূন্য দশমিক ৫০-এর ঘরে গেলে সেটাই বিপৎসীমা। দেশে দরিদ্র মানুষ ২০ শতাংশ ধরলেও ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে তারা ৩ কোটি ৬০ লাখ।

দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং আয়বৈষম্য ভালো কিছু নির্দেশ করছে না। এর সঙ্গে রাজনীতি ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ এবং বিদেশিদের সম্ভাব্য কঠোর চাপ দেশকে চরম দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি করতে পারে।

যাহোক, ঢাকায় ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের আগে বিএনপি নেতারা পুনঃপুন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দিলেও তাদের সভাস্থলে সংঘাত-সংহিসতার ঘটনা ঘটেছে। তারা বলেছেন, ‘পুলিশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।’ অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা বলছেন, ‘বিএনপির প্রকৃত সহিংস চেহারা ফুটে উঠেছে।’

এই সংঘাত-সহিংসতা ঘিরে জনমনে অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। এতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষ জড়িত ছিল কিনা– পুলিশ বা সরকারি কোনো সংস্থা নয়; নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এর সদুত্তর মিললেই জনমনে এ সন্দেহের অবসান ঘটবে।

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতার পর দেশ পুনরায় ২৯ অক্টোবর ফিরে পায় এক দিনের হরতাল এবং ৩১ অক্টোবর থেকে তিন দিনের রাজপথ, রেলপথ, নৌপথসহ দেশব্যাপী অবরোধ। প্রথম ধাপের অবরোধের পরপরই বিএনপি সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আবারও রোববার (৫ অক্টোবর) সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সারাদেশে সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয়।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও সমমনা দলগুলোর অবরোধে দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, যানবাহনে আগুন ও নিভেছে কমবেশি ১১টি প্রাণ। পাড়া-মহল্লায় পাহারায় রয়েছে সরকারি দলের নেতাকর্মী। 

পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স পোড়ানো; পিস্তল, শটগান ও রাইফেল ছিনতাই, সংঘাত-সহিংসতা, যানবাহনে আগুন ইত্যাদির অভিযোগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কেন্দ্রীয় নেতারাসহ সব পর্যায়ে নেতৃত্বশূন্য ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীশূন্য করতে ৯ দিনে সারাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছে বিএনপির ৯ হাজার নেতাকর্মী, যাদের মধ্যে ঢাকায় ৮৯ মামলায় আটক ২ হাজার ১৭২ জন। থেমে নেই ধরপাকড়। ফলাফল বিএনপি নেতাকর্মী বাড়িছাড়া।

আমেরিকাসহ শক্তিশালী সাতটি দেশ, জাতিসংঘ, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান সংঘাত-সহিংসতা পরিহার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে। কেউ কেউ বলেছে, ২৮ অক্টোবর সহিংসতাকারীরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ৩১ অক্টোবর বলেছেন, ‘বাংলাদেশে একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজতে সব পক্ষ শর্তহীন সংলাপে বসবে।’ একই দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘খুনিদের সাথে সংলাপ নয়, তারা নির্বাচন চায় না, অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, জো বাইডেন-ট্রাম্প সংলাপ হলে আমিও করব।’

বিএনপিও শর্তহীন আলোচনায় নারাজ। অর্থাৎ সংলাপের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আসলে সরকারি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনে গিয়ে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আবার বিরোধী দল লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার চায়। তা ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হেরে যেতে চায় না।

যদিও দেশের মানুষের কাছে নির্বাচন একটি উৎসব। আর ভোট হলো অধিকার। কিন্তু মানুষের মনে নানা প্রশ্ন। যেমন– অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কিনা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে কিনা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে কিনা, পশ্চিমাদের বড় কোনো চাপ আসবে কিনা।

সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার, নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ-প্রাণহানি অনেক দিন চলমান থাকতে পারে। যাই ঘটুক, তবুও বড় দুই দলই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে আত্মঘাতী লড়াই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চালিয়ে যাবে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে।

সরকার সব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং সরকারের আচরণ ও পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছে, তারা ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো একটি নির্বাচন আয়োজনের দিকেই এগোচ্ছে, যা ঘটলে দেশের জন্য মহাবিপদ নেমে আনতে পারে।

একটি ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে দেশকে ঠেলে না দিয়ে দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসন করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে বহির্বিশ্বের সব ধরনের হস্তক্ষেপ বা কঠোর ব্যবস্থা এড়াতে পারে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’ আছে, যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনীতি। প্রধানত, এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি জনগণ-সমর্থিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর রাখতে চায়, যাতে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে ঢুকে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী করতে না পারে বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে না পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে বাংলাদেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো অর্থবহ সংলাপ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে দেশটি নানা ধরনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন বলয় এটাকে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সমর্থন করছে।

এম এ আজিজ: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন