ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

এই বিচারহীনতার দায় কি আমরা এড়াতে পারি?

অধিকার

এই বিচারহীনতার দায় কি আমরা এড়াতে পারি?

সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:৫৮ | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৬:৩২

বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক নৈরাজ্য চলছে, তা সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিরাপত্তাবোধের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির কারণে জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাপন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। শিক্ষার্থী বিশেষ করে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ পর্যায়ের ছেলেমেয়ে ভয়ানক এক চাপের মুখোমুখি। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা নিতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এমনিতেই খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে সংসার চালাতে গিয়ে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের ত্রাহি অবস্থা। অবরোধের কারণে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবন চরম বিপন্নতায় গিয়ে ঠেকেছে। নিতান্ত অসংবেদনশীলভাবে বিএনপি তাদের অবরোধের সময় বাড়িয়েই চলেছে। কোনো রকম জনসম্পৃক্ততা না থাকায় এই অবরোধ ‘সফল’ করতে জোরজবরদস্তি আর সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে সাধারণ মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও মানুষও দগ্ধ হচ্ছে। বিএনপির তাতে কিছু আসে যায় কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে এই অরাজকতা কঠোর হাতে দমনের কথা বলা হলেও প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে অব্যাহত চোরাগোপ্তা হামলা মানুষের আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলেছে। এসবের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিদিন সরকারি ঘোষণা শুনছি, বিরোধী দলের এ অরাজকতা দমনে তারা কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পদক্ষেপ হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করে চলেছে। দুই দলের কারও এই উদ্ভূত পরিস্থিতির শেষ দেখার কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। বরং দুই দলই তাদের এই ‘খেলা’ যেন জিইয়ে রাখতে চায়। এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো সমাধানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা দূরে সরে যেতে থাকবে, সেটা যেন তাদের বিবেচনায় নেই। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার কথা সরকার বা বিরোধী দলের চিন্তাভাবনার কোথাও এতটুকু স্থান দখল করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। কথাবার্তায় এক দল বরং অন্য দলকে ক্ষেপিয়ে তুলতেই ব্যস্ত। দুই পক্ষের এই সহিংস রেষারেষির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। 

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পুলিশের প্রতিদিনের গণগ্রেপ্তারের পেছনের যেসব ঘটনা রয়েছে, তা অত্যন্ত ভয়ানক ও নিন্দনীয়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এই অপরাধমূলক কাজের হোতা যে বিএনপি কর্মীরা– সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। তাই নির্বিচারে তারা সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীকে আটক করে চলেছে। আমরাও বলে আসছি, অপরাধী যেই হোক না কেন তারা ধরা পড়ুক; বিচারের মাধ্যমে তাদের কৃতকর্মের জন্য তারা যথোপযুক্ত শাস্তি পাক, সেটা আমাদেরও কাম্য। আমাদের প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যারা ন্যক্কারজনকভাবে একজন দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করল; প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং অন্য বিচারপতিদের বাড়িঘরে হামলা করল; সাংবাদিকদের ওপর নিগ্রহ চালাল; যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ অব্যাহত রেখেছে, তাদের এবং তাদের হুকুম বা মদদদাতার সংখ্যা কত হতে পারে? তাদের সংখ্যা কি কয়েক হাজারেরও ওপরে? পুলিশ কি অপরাধের হোতা বা মদদদাতাদের, যেমন তারা দাবি করছে, নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত বা যুক্তিসংগত কারণে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করছে, নাকি বিএনপির সদস্য ও সমর্থকদের কোণঠাসা এবং জনগণকে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য এমন ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করে চলেছে? পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে নিয়ে আসা হয়। তারা জনগণের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য কী করছেন, তা সবাইকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে অনেক কথা বলেন। এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, তাদের বক্তব্য– খুব শিগগিরই তারা সব ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবেন এবং আসল অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনবেন। সরকারের উচ্চপদস্থ নেতা, যাদের মধ্যে মন্ত্রীরাও আছেন, অনবরত বলে চলেছেন– বিএনপির এই আচরণ তারা আর সহ্য করবেন না।
২৮ তারিখ থেকে বেশ কিছুদিন চলে গেল। এখনও আমরা মূলত উদ্বেগজনক সংখ্যায় গ্রেপ্তারের খবর পাচ্ছি। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিচারিক প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হচ্ছে, এমন খবর তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে এই নির্বিচার গ্রেপ্তারের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা যে নানা রকম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন, সেটিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। যাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে; গ্রেপ্তারের পর তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথায় রাখা হচ্ছে, পরিবারের সদস্যরা তা জানতে পারছেন না। যাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা হচ্ছে, কোনোভাবে খবর পেয়ে তাদের আত্মীয়স্বজন জেল থেকে জেলের দেয়ালে টাঙানো তালিকায় গ্রেপ্তারকৃতদের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছেন। দিনের পর দিন তারা সন্তান আর ভাইবোনের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন।

আমাদের অভিজ্ঞতায় জানি, এমন পরিস্থিতিতে লাগামছাড়া ধরপাকড়ে আরেকটা ভয়ের দিক হলো, গ্রেপ্তারকৃতদের পুরোনো কোনো মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের হিসাবমতে, বিএনপির শীর্ষ নেতা ও লে. জেনারেল (অব.) সারোয়ার্দী, মিয়া আরেফিসহ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি প্রায় তিনশ জনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ডিএমপি অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ৮৬ ধারায় আগের নাশকতা মামলা, নানা গায়েবি মামলার অজুহাতে হাজার হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত অনেকের স্বজনের দাবি, তারা বিভিন্ন কারাগারে খোঁজ করে নিকটজনের হদিস পাচ্ছেন না। অথচ বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ডিএমপি অ্যাক্ট-৮৬ এর আওতায় সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার করলে দ্রুততম সময়ে আত্মীয়স্বজনকে অবহিত এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা বাধ্যতামূলক। আদালতের রায়ে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি ভোগ করবে। নয়তো তাকে ছেড়ে দিতে হবে। পুলিশ কি তা করছে? আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, পুলিশের আসামির তালিকায় মৃত এবং প্রবাসী ব্যক্তিদের নামও আছে। 

খবরে প্রকাশ, কারাগারগুলো দ্বিগুণ, তিন গুণ বন্দিতে ঠাসা। অধিকাংশই বিনা বিচারে আটক। আগেই বলেছি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে পুলিশ সন্দেহবশত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যত গুরুতর অপরাধের অভিযোগই থাকুক না কেন, স্বল্পতম সময়ে তাকে বিচারের আওতায় সোপর্দ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা বিচারহীনতার পর্যায়ে পড়ে। দুঃখজনকভাবে আমরা সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সবাই চাই, সমাজে যে কোনো অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হয়ে অপরাধী শাস্তি পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন অবিচার বা বিচারহীনতার শিকার না হয়। এটি মেনে না চললে জাতি হিসেবে ইতিহাসের কাছে আমরা কেউ এই বিচারহীনতার দায় এড়াতে পারব না।

সুলতানা কামাল: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

আরও পড়ুন