স্মরণ
সুফিয়া কামাল: হার না মানা পরশমণি

সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১-২০ নভেম্বর ১৯৯৯)
সাঈদা কামাল
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:০৫ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৬:০৪
স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসে ১৯৫০-৬০ এর সেই মধুক্ষরা দিনগুলো; তারাবাগের মায়াঘেরা ছোট্ট বাড়িটি। জানা-অজানা হাজারো রকম গাছ; ফুলে-ফলে ভরা বিশাল বাগান; পুকুরঘেরা সুখে ভরা সেই একটি বাড়ি। বাবা সামান্য আয়ের অসামান্য ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। আদর্শবান, সৎ, উদার। মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নবাববাড়ির প্রবল ঐশ্বর্য, বিত্ত-বৈভব, জাত্যাভিমান ফেলে আমার বাবার সাধারণ সংসারে। লালপাড় শাড়ি আর হীরার নাকফুলে ঘর আলো করা আমাদের মা।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আমি; দলছুট আপন মনে ঘুরে বেড়াতাম জঙ্গলে, বনে-বাদাড়ে। দেখতাম কোন গাছে ফুটেছে আশ্চর্য নাম না জানা ফুল; কোথায় বাসা বেঁধেছে টুনটুনি তার ছানাপোনা নিয়ে; খুঁজে খুঁজে ফুল তুলে আনতাম বেগম সুফিয়া কামাল মায়ের জন্য। বেল, জুঁই, মেহেদি বা নেবুল– যা-ই হোক না কেন, হেসে সেই ফুল পরে নিতেন খোঁপায়। ফুল পরতে ভালোবাসতেন মা। ফুল পরা শেষ হলো ’৬৩-তে আমার মেজো ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর।
সংসার, রান্নাবান্না, ছেলেমেয়েকে দেখা, সেলাই-ফোঁড়াই সব কিছু সেরে মা কবিতা লিখতে বসতেন গভীর রাতে; সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে। কীভাবে সময় করে নিতেন, তা ভেবে আজও অবাক হই। কত ছোট-খাটো সুখস্মৃতি যে মনে আসে! পূর্ণিমার রাত। আকাশভাঙা জোছনায় ভেসে যাচ্ছে তারাবাগের বাসার ছোট্ট বারান্দা; হাসনাহেনার গন্ধে বাতাস ভারি। মা এস্রাজ বাজাচ্ছেন; ছড়ের আঘাতে আঘাতে বেজে ওঠে কার যেন কবেকার দুঃখগাথা! আমরা পাটি পেতে শুয়ে; সঙ্গে মায়ের আদরের পোষা বিড়ালটিও। রাত ক্রমে গভীর হয়; ঘুমে ঢলে পড়ি। সকালে উঠে দেখি, শুয়ে আছি নিজেদের বিছানায়।
মনে পড়ে, তারাবাগের আমবাগানের নিচে পুকুরপাড়ের ঘাটে বসেছেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, জয়নুল আবেদিন, আবদুল্লাহ আল-মুতী ও আবদুল ওয়াদুদ। উত্তেজনায় দাদাভাই বসে থাকতে পারছেন না; মা মুড়ি ভেজে পরিবেশন করছেন নিজ হাতে। সিদ্ধান্ত হলো শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা গঠনের। এভাবেই জড়িয়ে ছিলেন ওয়ারী মহিলা সমিতি, ছায়ানট, মহিলা পরিষদ, প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের মতো আরও বহু সংগঠনের সঙ্গে। বেরিয়ে পড়তেন রাজপথে, মিটিংয়ে, মিছিলে প্রতিরোধ আন্দোলনে, চাঁদা তুলতে বন্যাত্রাণে, ওয়ারী মহিলা সমিতির নানান কাজে, শিশুকল্যাণে, দুস্থ মহিলাদের পুনর্বাসনে। নেতৃত্ব দিতেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বহমান আন্দোলনে; সব হুমকি উপেক্ষা করে।
সে সময় ঘরে ঘরে ফোন ছিল না, গাড়ি ছিল না। হেঁটে, রিকশায় করে মাকে দেখেছি নিরলসভাবে কাজ করে যেতে। কোনোদিন ক্লান্ত হতে দেখিনি; দেখিনি মুখের হাসিটি ম্লান হতে। সেই সময়ে সংসারের হাল ধরতেন বাবা। মায়ের মিটিং থেকে ফিরতে দেরি হলে আমাদের পড়ানো শেষ করে ভাত মেখে মুখে তুলে দিতেন। সংসারের বহু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, যাতে মায়ের লেখার ওপর চাপ না পড়ে। অসংখ্য মানুষ এসেছে তাদের সমস্যা নিয়ে; মায়ের সঙ্গে দেখা করে ফিরে গেছে উজ্জ্বল মুখে। বাবা কামাল উদ্দিন আহমদ ছিলেন চট্টগ্রামের চুনতীর এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্যকর্ম বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যে পরিবারটির অবদান এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
বাবা তাঁর অভিজাত পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে এসেছিলেন সাধারণ মানুষের কাতারে। প্রবল ঐশ্বর্য, অর্থবিত্ত ছেড়ে ঘাড়ে ৫ বছরের মেয়ে আর মায়ের হাত ধরে মানুষটি পথে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন তাঁর জীবন সংগ্রাম। আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছেন; কিন্তু হার মানা তাঁর স্বভাবে ছিল না।
স্বামী হারিয়েছেন; হারিয়েছেন প্রিয় পুত্রকে, প্রিয় মানুষদের। ভেঙে পড়েননি ব্যক্তিগত শোক-দুঃখে। মনের মধ্যে ধারণ করেছেন এক পরশমণি; সেই আলোতেই পথ চলেছেন।
১৯২৫-এ গান্ধীজির আদর্শে দীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে দুস্থ নারী পুনর্বাসন– সর্বক্ষেত্রেই তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। জীবনের শেষ পর্যন্ত উদ্বিগ্ন থেকেছেন দেশের মানুষের দুর্দশা, অবক্ষয়, নৈরাজ্য নিয়ে। কোনোদিন রাজনীতি করেননি তিনি। অন্যায়কে অন্যায় বলেই জানতেন। সত্য ও মিথ্যার বিভাজন রেখাটি বড়ই স্পষ্ট ছিল তাঁর কাছে।
কোনো মানুষকে তিনি অনাদর করেননি; প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দেননি কাউকে। একবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মা থাকা অবস্থায় উপচে পড়া ভিড় সামাল দিতে আমরা বিব্রত, বিরক্ত; রীতিমতো ক্রুদ্ধ। এ সময়ে একজন ডাক্তার (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না) হেসে বললেন, ‘থাক না। আপনারা কত লোককে আর বারণ করবেন! ওনার কাছে যারা আসে; ভালোবেসেই তো আসে– লাইসেন্স-পারমিটের জন্য তো নয়।’
‘যারা আসে, ভালোবেসেই আসে’– এ কথাটি উপলব্ধি করেছিলাম যখন তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, তাঁর প্রিয় স্থান শহীদ মিনারে। হাজারো মানুষ যখন পরম মমতায়, ভালোবাসায়, আশ্চর্য সুশৃঙ্খলভাবে ফুলে ফুলে ঢেকে দেয় তাঁর শবাধার; শোকার্ত মানুষ নিঃশব্দ মিছিলে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। জানাজায় একই কাতারে এসে দাঁড়ায় স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বধর্মের, সর্বস্তরের হাজারো মানুষ; তখন মনে হয়, তাঁর মতো ভাগ্য নিয়ে ক’জন মানুষ জন্মায় এ পৃথিবীতে! এত মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা ক’জনের হয়!
সাঈদা কামাল: কবি বেগম সুফিয়া কামালের মেয়ে, চারুশিল্পী ও শিক্ষক