ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

রাজনীতি

কেউই আর কেয়ারটেকার সরকার ফেরত আনবে না

কেউই আর কেয়ারটেকার সরকার ফেরত আনবে না

মইনুল ইসলাম

মইনুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:১০ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩ | ২০:১০

বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি হয়েছিল ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুসারে; তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে। এ জন্য ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে।

কিন্তু এ তিন নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, প্রতিটি নতুন নির্বাচনে পূর্বের ক্ষমতাসীন দল বা জোট জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে প্রবল চপেটাঘাতের শামিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারানোতে নির্বাচনে কারচুপি করতে গিয়ে মাগুরায় ধরা খেয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত হলেও পরাজয় মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। 

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধানের ৭০ ধারার ইচ্ছামতো প্রয়োগের ক্ষমতা এই দু’জনের হাতে অর্পণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে সর্বনাশা একক ক্ষমতার অধিকারী করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের একক সিদ্ধান্তে এই দু’দলের যে কারও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। ফলে, ৭০ ধারার ভয়ে দু’দলেরই একদা বাঘা বাঘা নেতা-নেত্রী দলপ্রধানের একান্ত অনুগত অবস্থানে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ১৯৯১-২০০৬ পর্যায়ে এদেশে ভোটের গণতন্ত্র চালু থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে চলেছে ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’। এ থেকে জনগণ আজও মুক্তি পায়নি। 

২০০১ সালের নির্বাচনে খোদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সিভিল প্রশাসন এবং মাঠ পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তা প্রধান দু’দলের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর হাতিয়ার হয়ে গিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার মাসখানেক আগেই বিচারপতি লতিফুর রহমান তাঁর কথিত ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই কয়েকজন ভবিষ্যৎ উপদেষ্টাও তাঁর হোমওয়ার্কে অংশ নেন। একই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কয়েকজন আমলাও গোপনে তাদের নিজস্ব হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছিলেন– সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে ছক আওয়ামী লীগ সাজিয়ে রেখেছিল, তা কীভাবে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের রদবদল ও গণবদলির মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়া যায়। ওই সময়ের মুঈদ-মঈনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কুশীলবরা কীভাবে দু’মাসেরও কম সময়ে ১৫২৬ জন কর্মকর্তার বদলি সুসম্পন্ন করেছিলেন; সেই কাহিনি পরে ওই কুশীলব কয়েকজনের পত্র-পত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এর পর বিএনপি দফায় দফায় দাবি তুলল– ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে সারাদেশে; নয়তো আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ক সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের; পালিয়ে বাঁচল বীর পুঙ্গবরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল– ওই সত্যটাও এদ্দিনে খোলাসা হয়ে গেছে। অতএব, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে নির্বাচনী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত– তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাণ্ড-কারখানার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের সাজানো বাগান এবং ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কায়দা-কানুন ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং চরিত্রগতভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী (anti-incumbent)।

২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী থেকে বেছে বেছে আওয়ামীপন্থি ও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল। সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ করা হলো। অপমানজনকভাবে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে রাষ্ট্রপতি করা হলো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে। বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বিচারপতি কেএম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টের বিচারপতি করা হয়েছিল। তাঁকেই আবার ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবর’রা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দু’বছর বাড়িয়ে ৬৭ নির্ধারণ করে দিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতিচালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়লে শুরু হয়ে গেল হাসানবিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে। কিন্তু ওই মহাগুরুত্বপূর্ণ খবরটা জাতিকে না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন মোবাইল ফোনে তা জানালেন শুধু খালেদা জিয়াকে। তিনি তখন নয়াপল্টনের সভামঞ্চে।

টিভি ক্যামেরায় আমরাও দেখলাম, তিনি কলটি রিসিভ করে বক্তৃতা না দিয়েই তড়িঘড়ি মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িবহর নিয়ে সোজা চলে গেলেন বঙ্গভবনে। টিভি সাংবাদিকরা তাঁর ওই রহস্যজনক ‘বঙ্গভবন-গমন’ অনেকখানি কভার করাতে আমরা দর্শকরাও জানলাম ব্যাপারটা। ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় বঙ্গভবন থেকে জাতিকে জানানো হয়, স্বাস্থ্যগত কারণে বিচারপতি হাসান প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। ২৮ অক্টোবরের ওই বিকেল থেকে শুরু করে রাত ১২টার মধ্যেই নারকীয় দাঙ্গাহাঙ্গামায় ১২ জন মানুষ নিহত হয়েছিল সারাদেশে। এসব মানুষের মৃত্যুর জন্য খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন কি তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারবেন? এর পর তাদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারেই সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে গেলেন বিরোধী দলগুলোর অমত সত্ত্বেও। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দারকে নিয়োগ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন। কিন্তু ওই খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়াতে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এর ফলেই ১/১১-তে বাংলাদেশ আবারও ছদ্মবেশী সেনা শাসনের কবলে পড়েছিল। সেনাবাহিনীর সরাসরি দেশ শাসন করার খায়েশ ব্যর্থ হওয়ায় ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।

মূল বক্তব্য হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বারবার ‘ম্যানিপুলেশন’-এর শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-০৭ সালে। সর্বোপরি ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করলেন– অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক। তবে প্রয়োজন মনে করলে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। কিন্তু সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালকে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করেছে। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যতই জোরালো আন্দোলন করুক না কেন; ভবিষ্যতে গণঅভ্যুত্থানে বাধ্য না হলে আর কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করবে না। জেনেশুনে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় কি কোনো সরকার চাইতে পারে? 

ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

আরও পড়ুন