ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অর্থনীতি

ঋণ করে ঋণ পরিশোধের পরিণাম অশুভ

ঋণ করে ঋণ পরিশোধের পরিণাম অশুভ

প্রতিকী ছবি

আবু তাহের খান

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:২৫ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৯:৪২

২০১১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণদেনার পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১২ বছরের ব্যবধানে তা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে; বৃদ্ধির পরিমাণ ৭৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)। এ অবস্থায় খুবই উত্তম হতো গত ১২ বছরে গৃহীত ঋণ দিয়ে বাংলাদেশ কী কী কাজ করেছে তার একটি প্রকল্পওয়ারি, কার্যক্রমওয়ারি ও খাতওয়ারি অনুপুঙ্খ হিসাব তৈরি করতে পারলে। আর সে রকম একটি হিসাব তৈরি করা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ফল মূল্যায়নের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি তা জরুরি এসব কাজ থেকে হাসিলকৃত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ-সুবিধাদির মাত্রা ও প্রবণতা মূল্যায়নের জন্যও। প্রথম কাজটি, অর্থাৎ প্রকল্পওয়ারি ফল মূল্যায়নের বিষয়টি প্রকল্প দলিলের শর্ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক এবং সে কারণে গতানুগতিক ধারায় তা কিছুটা হচ্ছেও। কিন্তু দ্বিতীয় কাজটি, অর্থাৎ ওই সব প্রকল্পের বাস্তবায়নজনিত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সুবিধা হাসিলের মাত্রা ও প্রবণতা নিরূপণের কাজটি অদ্যাবধি হয়নি এবং আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কখনও তা করতে সম্মত হবেন বলেও মনে হয় না। অথচ কাজটি শুধু জরুরি নয়, বৃহত্তর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তা অত্যাবশ্যকীয়ও। এ অবস্থায় দেশের স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ কাজে এগিয়ে এলে একটি বড় প্রয়োজন পূরণ হয় বলে মনে করি।

এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন প্রতিবেদন না থাকলেও জনসমক্ষে, গণমাধ্যমে ও সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায় যেসব তথ্য রয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে গত ১২ বছরে গৃহীত ঋণের আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই মুষ্টিমেয় নাগরিক-বিত্তবানের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত মেগা প্রকল্প। এগুলো থেকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষে সুবিধা ও উপকারভোগের সুযোগ খুবই সীমিত। তার মানে জনস্বার্থের কথা বলে আনা হলেও উচ্চব্যয়ী ও কঠিন শর্তের এসব ঋণ বস্তুত ক্ষমতা কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থানকারী বিত্তবান সুবিধাবাদীদের স্বার্থকেই রক্ষা করে চলেছে। দ্বিতীয়ত, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ অর্থ বা ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে, প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই তা যৌক্তিক পরিমাণের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি প্রকল্পের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রামাণ্য তথ্য বলছে, উল্লিখিত প্রকল্পগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়িত সমমানের অনুরূপ অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে।

এ সময়ে বাস্তবায়িত বৈদেশিক ঋণপুষ্ট অন্যান্য প্রকল্পের ব্যয়ই হয়তো তিন গুণ বাড়েনি। কিন্তু এখানে এমন একটি প্রকল্পও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেগুলোর বাস্তবায়ন ব্যয় যৌক্তিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি ছিল না। এ অবস্থায় গড়পড়তা হিসাবে এ প্রকল্পগুলোতে যদি ৮০ শতাংশ অর্থও বেশি ব্যয় হয়ে থাকে, তাহলে তার মানে হচ্ছে, সরকার গত ১২ বছরে বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের জন্য যে ৭৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে, সেগুলো ৪১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। অর্থাৎ এ ধরনের অযৌক্তিক ব্যয় প্রাক্কলনের কারণে বাংলাদেশকে ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে; যা অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা বা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এই পরিমাণ ঋণ কম গ্রহণ করতে পারলে দেশের বৈদেশিক ঋণদেনার পরিমাণও এ সময়ে অনেক কম হতো। ফলে গোষ্ঠীবিশেষের অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা ও অপচয়ের বোঝা এখন টানতে হচ্ছে দেশের অসহায় সাধারণ মানুষকে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের নানা জায়গায় এমন বহুসংখ্যক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো বর্তমানে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অথচ দেশে এমন বহু বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে ভবনের অভাবে শিক্ষার্থীদের গাছতলায় বা অন্যত্র ক্লাস করতে হচ্ছে; যার ছবি মাঝেমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসী যানবাহন ক্রয়, অপ্রয়োজনীয় পরামর্শসেবা গ্রহণ, সভা-সেমিনার-কর্মশালা আয়োজন, রান্না, চাষাবাদ ও পুকুর খনন শিখন ইত্যাদির মতো পরিহারযোগ্য কাজ দেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটে চলেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু কাজ নিজস্ব সম্পদ দিয়ে মাঝেমধ্যে সীমিত পরিসরে হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে? ঋণ করে ঘি খাওয়া বিলাসিতা হলেও জিহ্বার স্বাদ পূরণের জন্য কখনও কখনও তা হয়তো সীমিত পরিসরে মেনে নেওয়া যায়। তাই বলে ঋণ করে বিষ তো খাওয়া যায় না! অথচ পর্যাপ্ত যৌক্তিক কারণ ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এভাবে একের পর এক বৈদেশিক ঋণযুক্ত প্রকল্প গ্রহণের ধারা চলছে তো চলছেই।
বণিক বার্তার গত ২৬ নভেম্বরের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সরকার এখন বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য নতুনভাবে ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আর পরিকল্পনামন্ত্রী জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও ঋণ গ্রহণ করা হবে। কী ভয়ংকর কথা! ইতোমধ্যে গৃহীত ঋণ পরিশোধেরই যেখানে সামর্থ্য নেই, সেখানে আবারও নতুন করে ঋণ গ্রহণ? বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার কার্যকর মজুত যেখানে ইতোমধ্যে ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে এবং সে অবস্থায় ঋণদেনার পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টাই যেখানে হওয়া উচিত মুখ্য বিবেচনা, সেখানে কিনা বলা হচ্ছে আরও ঋণ গ্রহণ করা হবে। তো, এই ঋণ কে কীভাবে পরিশোধ করবে, তার কোনো ব্যাখ্যা কি ঋণগ্রহীতার কাছে আছে? এসব ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে প্রকল্প দলিলে যে ধরনের পদ্ধতির কথা বলা আছে, তা মেনে ওই সব ঋণ যথাসময়ে ও যথানিয়মে পরিশোধ করা কি সম্ভব?

জনগণের নাম করে এই যে একের পর এক ঋণ গ্রহণ, সেসব ব্যাপারে জনগণের কোনো সম্মতি কি কখনও গ্রহণ করা হয়েছে? এসব নিয়ে কখনও কি জাতীয় সংসদে, সংসদের স্থায়ী কমিটিতে কিংবা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কোনো ফোরামে কখনও কোনো আলোচনা হয়েছে? তাহলে ঋণ গ্রহণ-সংক্রান্ত এসব সিদ্ধান্ত কারা কীভাবে নিচ্ছেন? আসলে এসব সিদ্ধান্তের পুরোটাই গৃহীত হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ে ও প্রক্রিয়ায়, জনগণের কাছে যাদের কোনো জবাবদিহি নেই। ঋণ জনগণের কী কাজে আসবে, এ ঋণ তারা কীভাবে পরিশোধ করবেন? কিন্তু জনগণের প্রতি জবাবদিহি ও মমতা কোনোটিই যেহেতু নেই, সেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তারা তো পুরোপুরি স্বাধীন এবং সে স্বাধীন সিদ্ধান্তই এখন তারা পরিপূর্ণ কর্তৃত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তারই অনিবার্য ফল দাঁড়িয়েছে এই, দেশের বৈদেশিক ঋণদেনার পরিমাণ এখন ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি; যা পরিশোধের সামর্থ্য এ দেশের জনগণের একেবারেই নেই।

এ অবস্থায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কথার ফুলঝুরি দিয়ে সমস্যার ভয়াবহতাকে যতই আড়াল করার চেষ্টা করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে যে বৈদেশিক ঋণের বর্তমান বোঝা এখন বাংলাদেশের জন্য সত্যি অবহনযোগ্য হয়ে উঠেছে। দায়িত্বরত রাজনীতিক ও আমলারা হয়তো এসব করে কোনোরকমে নিজেদের সময়টুকু পার করে দেবেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে তারা অনিবার্যভাবেই ফেলে রেখে যাবেন এক চরম দুঃসময় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে নিকট ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যে বস্তুতই এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, সে বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্তপ্রণেতারা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, দেশ ও জনগণের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক হয়ে উঠবে বৈকি!

আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×