শিক্ষাব্যবস্থা
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অসন্তোষ কেন?

আলতাফ হোসেন রাসেল
আলতাফ হোসেন রাসেল
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৪৯
বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য মাত্রাতিরিক্ত চাপ দেওয়া হয়; খেলাধুলা করা ও মানসিক বিকাশের তেমন কোনো সুযোগ নেই– এটা আমাদের দীর্ঘদিনের সমালোচনা। সেই প্রেক্ষাপটে ফিনল্যান্ডের মতো একটি দেশের শিক্ষাক্রম দেশে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে– শুনে সবারই আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল। কারণ আমরা জানি, ইউরোপ বিশেষত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর নীতিনির্ধারকরা শিশু ও পরিবেশ বিষয়ে খুবই যত্নশীল। তারপরও বিতর্ক কেন?
আমরা যারা পরিবেশ আন্দোলন করি, তারাও একসময় আনন্দিত হয়েছিলাম বাংলাদেশে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের কথা শুনে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত না করেই নেদারল্যান্ডসের আদলে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের তোড়জোড় চলছে! অথচ ডাচ্ ডেল্টা প্ল্যানের মূল তরিকা হচ্ছে নদী ও খাল সচল রাখা, যেন বৃষ্টি ও ঢলের পানি বিনা বাধায় সাগরে যেতে পারে।
মনে আছে, পরিবেশবিষয়ক এক সেমিনারে প্রথিতযশা এক পানি বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাদের মতো ব্যক্তিরা এই পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার পরও কেন এমন হলো? কিছুক্ষণ বিতর্কের পর তিনি বলতে বাধ্য হলেন, তারা আসলে ‘বি’ টিমে কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ে একটা ‘এ’ টিম আছে, যেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।
ফিনল্যান্ডের মতো দেশের শিক্ষাক্রম বাংলাদেশে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ডেল্টা প্ল্যানের চেয়েও বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। এ রকম একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপক প্রস্তুতি ও বিশেষজ্ঞ আলোচনা দরকার। সে জন্য আগে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন দরকার। যে কমিশন দীর্ঘ মেয়াদে গবেষণা ও পরিকল্পনা করে এ ধরনের মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। এ ধরনের বড় উদ্যোগ কোনো ‘এ’ টিমে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া হবে আত্মঘাতী।
প্রথমে ফিনল্যান্ডের কথা শুনে আমিও খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু গত ১ ডিসেম্বর একটি দৈনিক সংবাদপত্রে অধ্যাপক ডক্টর কামরুল হাসান মামুনের ‘ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন’ শিরোনামে নিবন্ধটি নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, আমরা যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ফিনল্যান্ডের মডেল বাস্তবায়নের দাবি করছি, সেটা ঠিক নয়। কারণ যে কোনো একটি মডেল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষায় ফিনল্যান্ডের মতো আর্থিক বরাদ্দ, ফিনল্যান্ডের মানের শিক্ষক ও সুযোগ-সুবিধা। বাংলাদেশ সেগুলো নিশ্চিত না করেই ফিনল্যান্ডের মডেল বাস্তবায়নের দিকে যেতে চাচ্ছে। অনেকটা নদী ও খাল সচলের পূর্বশর্ত পূরণ না করেই নেদারল্যান্ডসের মতো ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন।
অধ্যাপক নাসরীন সুলতানা গত ২৫ নভেম্বর ‘যে কারণে আমি এই নতুন কারিকুলামের বিপক্ষে’ শিরোনামে আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে নতুন কারিকুলামকে ‘ইউটোপিয়া’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। দীর্ঘদিন চলে আসা একটি শিক্ষাক্রমকে এক লাফে পরিবর্তন করার বিপক্ষেও বলেছেন। নবম শ্রেণিতে আগের মতোই বিজ্ঞান ও গণিতের বিষয় রেখে দেওয়ার দাবি করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি ২৫ শতাংশ অ্যাসাইনমেন্ট এবং প্রজেক্টে রেখে বাকি নম্বর পরীক্ষায় বরাদ্দ রাখার কথা বলেছেন।
আমার বিশ্বাস, নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতাকারীরাও বাংলাদেশের বর্তমান পদ্ধতিতে ঘন ঘন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম চাপ দূর করার পক্ষে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুরুতে বর্তমান শিক্ষাক্রমে কি পরীক্ষার এত চাপ ছিল? আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন তো পরীক্ষার এত চাপ ছিল না। এগুলো মূলত বিভিন্ন সময়ে নীতিনির্ধারকদের অতিরিক্ত আবেগের অতিরিক্ত সংযোজন।
নতুন শিক্ষাক্রমের সমর্থকরা ঘুরেফিরে একটাই অকাট্য যুক্তি হাজির করতে পারছেন– বর্তমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ। তাহলে তো এই সমস্যার সমাধান বিদ্যমান শিক্ষাক্রমেই সম্ভব। নীতিনির্ধারকদের অতিরিক্ত আবেগ সামলাতে হবে। আবেগে পিএসসি ও জেএসসির মতো যেসব অতিরিক্ত পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো হয়েছিল, তা বাদ দিতে হবে।
যতদূর মনে পড়ে, পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা উদ্ভবের সময় দেশের অনেক শিক্ষাবিদ তার বিরোধিতা করেছিলেন। তখনও এই বিরোধিতা আমলে নেওয়া হয়নি। এই অতিরিক্ত পরীক্ষাগুলো তো খুব বেশিদিন আগে সংযোজন হয়নি। সংযোজনের সময় যে শিক্ষা সচিব ছিলেন, তিনি হয়তো এখন পিএসসির চেয়ারম্যান, না-হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব বা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনের মাঠে।
নীতিনির্ধারকরা যদি বলেন, শুধু পরীক্ষার চাপ কমাতে চাই না; আমরা ফিনল্যান্ডের মতো একটি উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চাই; তাহলে এটি অনেক বড় ঘটনা, আরও বড় পরিসরে ভাবতে হবে। শুধু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর নয়; ফিনল্যান্ডের মতো করে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার শিক্ষাক্রমও সে অনুযায়ী সমন্বয় করতে হবে। কারণ উচ্চ মাধ্যমিক থেকেই ধীরে ধীরে আমাদের ছাত্ররা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। বাংলাদেশের একজন মেধাবী ছাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেন বিপদে না পড়ে, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
বর্তমান শিক্ষাক্রমেই বিজ্ঞানের একজন ছাত্র যে মাত্রায় বিজ্ঞান, বিশেষত গাণিতিক বিজ্ঞান পড়ে, তাতেই উন্নত বিশ্বে পিএইচডি করতে গেলে এমনকি অর্থনীতির মতো সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়েও হিমশিম খেতে হয়। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অর্থনীতির ডিগ্রি বিএসসি ও এমএসসি হিসেবে দেয়। মানবিকে বিজ্ঞানের আধিপত্য বেড়েছে। খুব উচ্চ লেভেলের তাত্ত্বিক কিছু গবেষকের কথা যদি বাদ দিই তাহলে ফলিত গণিত বা পরিসংখ্যানের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে গবেষণা ভালো জায়গায় প্রকাশ করতে পারছে না। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে খুব নামিদামি অধ্যাপক থাকলেও অধিকাংশের প্রকাশনার মান খুব খারাপ। কারণ তাদের এই বৈজ্ঞানিক বা কোয়ানটিটেটিভ স্কিল ব্যবহারের অদক্ষতা রয়েছে। গবেষণায় বাংলাদেশে যেসব জালিয়াতির অভিযোগ আসে, তার অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন থেকে। মৌলিক বিজ্ঞানকে এক প্রকার অবহেলা করে, শুধু প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে বুয়েটের মতো দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের প্রতিষ্ঠানটিও কিন্তু বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে পারছে না।
সারাবিশ্বে যেখানে বিজ্ঞানের আধিপত্য বাড়ছে, সেখানে ফিনল্যান্ডের মতো আধুনিক ব্যবস্থাতেও নিশ্চয় তা-ই হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে বিজ্ঞানের অংশ কমিয়ে আনার প্রসঙ্গ আসছে কেন! হতে পারে, একটা বিষয় আমরা ক্লাস নাইনে না পড়ে টেনে পড়ব। হতে পারে, কিছু বিষয় ঐচ্ছিক রেখে দেব। ফিনল্যান্ডের মডেলের পূর্বশর্ত পূরণ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক একটা সমন্বয় দরকার, যা উল্লিখিত ‘এ’ টিমে সম্ভব নয়। আমরা যদি কম বেতনে নিম্নমানের শিক্ষক দিয়ে প্রাথমিক স্তরে ফিনল্যান্ডের মডেল, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আমলাতান্ত্রিক এবং উচ্চশিক্ষায় দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাংলাদেশি মডেল চালাই, তাহলে নিশ্চয় ভালো কিছু হবে না।
বলে রাখা ভালো, ফিনল্যান্ডের মডেল বাস্তবায়ন করার পূর্বশর্ত পূরণ করা এখন অতটা সহজ হবে না। আমরা ইতোমধ্যে দুষ্ট গরু দিয়ে গোয়াল পূর্ণ করে ফেলেছি। গোয়াল দুষ্ট গরুশূন্য না করে বাজেট বাড়ালেও খুব বেশি কাজে আসবে না। শিক্ষায় যেটুকু বাজেট দেওয়া হয়, সেটুকুরও সঠিক ব্যবহার হয় না।
এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকদের উচিত উল্লিখিত পূর্বশর্ত এবং তা বাস্তবায়নের জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সূচনা করা, যাতে সবাই মতামত দিতে পারেন। অন্য দেশের একটি মডেল বাস্তবায়ন করার কিছু জটিলতা যে থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে মন খোলা আলোচনা ও উল্লিখিত জটিলতার স্বীকৃতিও পারে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে। তা ছাড়া ফিনল্যান্ডের মতো কারিকুলামেও মানুষের অনাস্থা ও অসন্তোষ থেকে যাবে।
আলতাফ হোসেন রাসেল: পিএইচডি গবেষক, অ্যাডাম স্মিথ বিজনেস স্কুল, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে
altaf.hossain@glasgow.ac.uk