ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

সুদহার নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি যুক্তিসংগত

সুদহার নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি যুক্তিসংগত

মামুন রশীদ

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন 

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৩৫ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:১৩

মামুন রশীদ প্রখ্যাত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করেছেন তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে। দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত ছিলেন অনেক বছর। ছিলেন ‘বেটার বিজনেস ফোরাম’ ও ‘রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন’, নতুন আয়কর আইন ও বিডার বিনিয়োগ আকর্ষণে আইনি সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্য। দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন 

সমকাল: ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে এই মুহূর্তে কী করা উচিত? মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে করণীয় বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

মামুন রশীদ: ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার জন্য প্রথমত সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে সহজ ও গতিশীল করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসা শুরু ও পরিচালনার ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং, কর প্রদান এবং আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা উচিত। একটি ‘ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’ পোর্টাল কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে উদ্যোক্তারা দ্রুত এবং সহজে সেবা পাবেন। মধ্য মেয়াদে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বেসরকারি খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুবিধা নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং খাতে সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে, যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ সহজেই ঋণ পায়। একই সঙ্গে সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নত করতে এবং উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ট্যাক্স ইনসেনটিভ দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজন একটি সুবিন্যস্ত শিল্পনীতি, যা প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যের ওপর জোর দেবে। বিদ্যমান রপ্তানি বাজারগুলোর পাশাপাশি নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ডিজিটালাইজেশন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হবে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সংলাপ বাড়ানো উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগ যদি সঠিক পথে এগোয়, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে স্থিতিশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা এনে দেবে।

 সমকাল: আপনার দীর্ঘদিনের কর্মঅভিজ্ঞতা থেকে দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন কোন চ্যালঞ্জে তীব্র মনে হয়েছে?

মামুন রশীদ: দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ কয়েকটি উচ্চকিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রথমত, অবকাঠামোগত দুর্বলতা। উন্নত সড়ক, রেলপথ এবং বন্দর অবকাঠামোর অভাব রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বিশেষত, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও আধুনিকীকরণের অভাবে লজিস্টিক খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, নীতিগত অস্থিরতা। ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি। তৃতীয়ত, দেশে গ্রোথ ক্যাপিটালের অভাব। সঠিক উদ্যোক্তারা এখনও পুঁজির অভাবে ভোগে। অন্যদিকে আমাদের করনীতি ও আমদানি-রপ্তানি নীতির প্রায়ই পরিবর্তন উদ্যোক্তাদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। এর পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। চতুর্থত, প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতি। আমাদের শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত এবং শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। ফলে, আমরা রপ্তানিতে উচ্চমূল্য সংযোজন করতে পারি না, যা গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পঞ্চমত, পণ্য বহুমুখীকরণের অভাব। তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে না পারলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলোর প্রভাব মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। এবং সবশেষে, জ্বালানি সংকট এবং মূল্যস্ফীতি। ব্যবসায়িক খরচ ক্রমাগত বাড়ছে, যা উৎপাদনশীল খাতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজন সুসমন্বিত নীতি, সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
 

সমকাল: বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে খুবই কম মাত্রার। এর কারণ কী?

মামুন রশীদ: বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, যা অর্থনীতির সম্ভাবনাময় উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, বিনিয়োগে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তারা বেশ কিছু কারণে নিরুৎসাহিত হন। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো বিনিয়োগের প্রক্রিয়াগত জটিলতা। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে হলে দীর্ঘ ও জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। বিনিয়োগ অনুমোদন, জমি অধিগ্রহণ, এবং বিভিন্ন লাইসেন্স প্রাপ্তিতে সময়ের অপচয় বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশাজনক। দ্বিতীয়ত, রয়েছে আমাদের অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। উন্নত সড়ক, রেল, এবং বন্দর সুবিধার অভাবে লজিস্টিক খরচ অনেক বেশি। বিশেষ করে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির স্থায়ী সরবরাহ না থাকায় উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, নীতিগত অনিশ্চয়তা। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল নীতি কাঠামোর ওপর নির্ভর করেন। তবে, বাংলাদেশে নীতির প্রায়ই পরিবর্তন এবং তার বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাব তাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। চতুর্থত, বিচারিক প্রক্রিয়া ও আইনি কাঠামো। বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে সময়ক্ষেপণ এবং আইনি কাঠামোর অকার্যকারিতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় প্রতিবন্ধক। পঞ্চমত, সহজে পুঁজি আনা ও প্রত্যাহারের সুযোগ, ষষ্ঠত, নিরাপত্তা ও দুর্নীতি। ব্যবসায়িক চুক্তি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাব এবং দুর্নীতির প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, যেখানে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ, অবকাঠামো উন্নত এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায়িক সমর্থন বা নীতি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে।

 সমকাল: মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি করা হচ্ছে এই যুক্তিতে যে, এর ফলে ব্যবসার খরচ বাড়বে। বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

মামুন রশীদ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি একটি প্রচলিত নীতি। তবে এর প্রভাব বহুমুখী। একদিকে এটি মূল্যস্ফীতি হ্রাসে সহায়তা করতে পারে, অন্যদিকে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক খরচ বাড়িয়ে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করে দিতে পারে। যখন মূল্যস্ফীতির চাপ সরবরাহ ঘাটতির চেয়ে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে সৃষ্টি হয়, তখন সুদহার বৃদ্ধি কার্যকর হতে পারে। তবে ব্যবসায়ীদের আপত্তি যুক্তিসংগত। উচ্চ সুদহার মানে ঋণের খরচ বৃদ্ধি, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রম, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর (এসএমই) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যের দাম কমানো কঠিন হয়ে পড়ে, যা আবার মূল্যস্ফীতিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে। তদুপরি, বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সাধারণত আমদানিনির্ভর। জ্বালানি ও খাদ্যের মতো পণ্যের দাম বিশ্ববাজারের ওঠানামার ওপর নির্ভর করে। তবে শুধু সুদহার বৃদ্ধি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। বরং সরবরাহ শৃঙ্খল উন্নয়ন, উৎপাদনশীল খাতে উদ্দীপনা প্রদান এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা উচিত। আমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি প্রয়োজন, যা একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে এবং অন্যদিকে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার নীতিতে নমনীয়তা ও সেক্টরভিত্তিক সহায়তা বাড়ানো এই মুহূর্তে কার্যকর সমাধান হতে পারে।

আরও পড়ুন

×