ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

পার্বত্য চুক্তি

২৭ বৎসর অতিক্রান্ত...

২৭ বৎসর অতিক্রান্ত...

প্রতীকী ছবি

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০১

২৭ বৎসর পূর্বে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অধিকাংশ ধারা অদ্যাবধি অবাস্তবায়িত থাকিবার বিষয়টি নিঃসন্দেহে হতাশাজনক। হতাশা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীসমূহের নহে; সমতলের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মধ্যেও বিরাজ করিতেছে। প্রথমত, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তিটি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্যাঞ্চলে দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক কালব্যাপী  চলমান সশস্ত্র সংঘাতের অবসান। কিন্তু যাহা বাস্তবতা, জেএসএসের সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ হইলেও ইতোমধ্যে তথায় ছয়টি আঞ্চলিক দলের উদ্ভব হইয়াছে। এই সকল দল পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত। ফলে এতদঞ্চলে শান্তি সুদূরপরাহত। দ্বিতীয়ত, পাহাড়িদের প্রধান উদ্বেগ হইল বিশেষত সমতল হইতে পুনর্বাসিত বাঙালির সহিত ভূমি বিরোধ, যাহা নিষ্পত্তির লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। সত্য, সমস্যাটি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। উক্ত আইনটি সংশোধনপূর্বক কার্যকর করিবার লক্ষ্যে পাহাড়িদের সম্মতি লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে পাসও হয়। তবে অদ্যাবধি আইনটি কার্যকরে প্রয়োজনীয় ভূমি কমিশন বিধিমালা প্রণীত হয় নাই। উপরন্তু অদ্যাবধি ছয়বার ঐ কমিশনের চেয়ারম্যানের পরিবর্তন হইলেও ভূমি বিরোধ সমস্যার সমাধান হয় নাই। সোমবার সমকালের প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, এই বিষয়ে সংক্ষুব্ধদের নিকট হইতে প্রায় ২৩ সহস্র আবেদন জমা পড়িলেও সংশ্লিষ্টদের তীর্থ-কাকবৎ অপেক্ষা করিতে হইতেছে। এইদিকে ইতোমধ্যে ষষ্ঠবার নিয়োগপ্রাপ্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হইলেও নূতন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় নাই। 

প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীদের কীভাবে মূল্যায়ন করে উহাই এখনও স্পষ্ট নহে। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হইলেও উহা বাস্তবায়নে কোনো সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা লইয়া অগ্রসর হয় নাই। অথচ তথাকার বাসিন্দারা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক; অন্য সকল নাগরিকের ন্যায় শান্তি ও স্বস্তির সহিত বসবাসের অধিকার তাহাদেরও রহিয়াছে। উপরন্তু দীর্ঘ সময় ধরিয়া পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন না হইবার কারণে পাহাড়িদের মধ্যে যেই হতাশা জন্ম লইয়াছে, উহাকে দুষ্কর্মে লাগাইয়া দেশি-বিদেশি কুচক্রী পার্বত্যাঞ্চলকে অধিক অশান্ত করিয়া তুলিতে পারে। ইহার প্রবল নেতিবাচক প্রভাব বিশেষত বাংলাদেশের ন্যায় একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অসহনীয় হইতে পারে। বিশেষত মিয়ানমারের অব্যাহত অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে বাংলাদেশ কীভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত রোহিঙ্গা সমস্যায় জড়াইয়া গিয়াছে, যাহা ইতোমধ্যে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা কাহারও অজ্ঞাত নহে। বান্দরবানের কুকি চিন সমস্যায় স্পষ্ট– ইতোমধ্যে মিয়ানমারের আরাকান ও চিন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুরের সাম্প্রতিক সংঘাত-সংঘর্ষের আঁচ পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাওয়া যাইতেছে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ নহে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চল সৌন্দর্যেরও লীলাভূমি। অর্থাৎ এই অঞ্চল অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও মহামূল্যবান। তাই অঞ্চলটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা জাতীয় নিরাপত্তা এবং অগ্রগতির স্বার্থেই জরুরি তজ্জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন কেবল জাতিগত পরিচয়ে নহে, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক হইতেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পার্বত্যাঞ্চলের মূল বাসিন্দাদের অভাব-অভিযোগসমূহের শান্তিপূর্ণ সমাধান। 
আমাদের প্রত্যাশা, যেই সকল ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি লালনের কারণে অতীত সরকারসমূহ দশকের পর দশক পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত রাখিবার বিলাসিতা দেখাইয়াছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উহা হইতে বাহির হইয়া আসিবে। তাহারা পার্বত্য চুক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করিবে, দ্রুত উহা বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং রোডম্যাপ ঘোষণা করিবে। প্রধানত বৈষম্যহীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়া যাহারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব লইয়াছেন, দেশের এক-দশমাংশকে বঞ্চিত রাখা তাহাদের উচিত নহে।

আরও পড়ুন

×