জাতীয় ঐক্য
অনৈক্য নির্মূলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি
প্রতীকী ছবি
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৫
জাতীয় ঐক্যের আহ্বান লইয়া ছাত্র নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার যেই ধারাবাহিক বৈঠক মঙ্গলবার হইতে চলিতেছে, উহা নিঃসন্দেহে যথার্থ ও সময়োচিত। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর হইতে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেই অপপ্রচার চলিয়া আসিতেছিল, উহা সম্প্রতি নজিরবিহীন নিকৃষ্টতায় উপনীত। সর্বশেষ যেইভাবে দেশটির ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশন স্থাপনায় হামলা হইয়াছে; উহাতে কেবল সৎ প্রতিবেশীসুলভ শিষ্টাচার নহে; কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতাও লঙ্ঘিত হইয়াছে। আমরা আরও বেদনা ও বিস্ময়ের সহিত দেখিতেছি, কেবল ধর্মীয় উগ্রপন্থি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলিই নহে; দেশটির মধ্যমপন্থি, এমনকি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলিও যেইভাবে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে নামিয়া পড়িয়াছে, উহা অতীতে কদাচ দেখা যায় নাই। স্বীকার্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয় কম নাই। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর হস্তে যেইভাবে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হইয়া থাকে, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের সেই অঘটনও আমাদের কম বিক্ষুব্ধ করে না। সমুদ্র ও স্থল সীমান্ত লইয়াও মতবিরোধ রহিয়া গিয়াছিল কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত। কিন্তু অতীতে কখনোই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এইভাবে অপপ্রচার এবং হাইকমিশনে হামলার প্রায় অভাবনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নাই। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ লইয়া যথাকর্তব্যই পালন করিয়াছেন।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার জবাব দিতে সরকারকে সমর্থন জানাইয়াছে বুধবারের বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির ভিন্নতা থাকিতে পারে; কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি যখন হুমকির সম্মুখীন; হাইকমিশনে হামলার মধ্য দিয়া যখন কার্যত সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হইয়াছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলির অভিন্ন অবস্থানই কাম্য। আলোচ্য
বৈঠকে জাতীয় ঐক্য কেবল ধরিয়া রাখিবার বিষয় নহে, প্রদর্শনেও কেন্দ্র ও প্রান্তে যৌথ সমাবেশের যেই পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে, উহাও যথার্থ। এমনকি ভারতসহ বিভিন্ন বৈদেশিক অপপ্রচার মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তায় রাজনৈতিক পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করিবার যেই প্রস্তাব আসিয়াছে, উহাও খতাইয়া দেখা যাইতে পারে। ইহার সহিত অবশ্যই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দেশের সরকারি-বেসরকারি সংবাদমাধ্যম ও সংবাদ সম্পর্কিত সংস্থাগুলিকে সক্রিয় করিতেই হইবে।
আমরা মনে করি, ইহাও ভুলিয়া যাওয়া উচিত হইবে না যে, অভ্যন্তরীণ ঐক্য শক্তিশালী করিবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি। ভারতের পক্ষ হইতে যেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলিয়া অপপ্রচার চলিতেছে, উহার বাস্তবতা চাহিলেও অস্বীকার করা যাইবে না। বস্তুত দেশভাগের পর হইতেই এইরূপ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নির্যাতন মাত্রাভেদে চলিয়া আসিতেছে। গত দেড় দশকেও উহার ব্যত্যয় ঘটে নাই। কিন্তু তখন দেখা গিয়াছে, ভারতের পক্ষ হইতে এই সকল বিষয় লইয়া টুঁ শব্দটিও করা হয় নাই। স্পষ্টতই এই দফায় অভিযোগ ও অপপ্রচারের নেপথ্যে রহিয়াছে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ। এই ক্ষেত্রে আমাদেরও সতর্ক হইতে হইবে যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলিবার ন্যূনতম সুযোগও যেন প্রতিপক্ষ না পায়। এই জন্য ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে হইবে। তাহারা যাহাতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মূলধারায় নির্বিঘ্নে মিশিয়া যাইতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করিতে হইবে। উহা কেবল সরকারের একার পক্ষে সম্ভবপর নহে; আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিকেও আন্তরিকতার সহিত আগাইয়া আসিতে হইবে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখিতে পারে খোদ রাজনৈতিক দল। জাতীয় ঐক্যের বৈঠকে গিয়া রাজনৈতিক দলগুলি যেই ইতিবাচক বক্তব্য দিয়াছে, উহার প্রতিফলন কার্যক্ষেত্রে ঘটাইতে পারিলে দেশে সংখ্যালঘু ইস্যু লইয়া অপপ্রচারের সুযোগই কমিয়া যাইবে বহুলাংশে। কেবল বৈঠকের আয়োজন নহে; দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এইরূপ জাতীয় ঐক্য সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত করিবার উদ্যোগ লইতে হইবে অবশ্য সরকারকেই।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়