মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন
অতীতের পুনরাবৃত্তি চাহি না
প্রতীকী ছবি
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫
পুনরায় যাচাই-বাছাইপূর্বক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের যে সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার গ্রহণ করিয়াছে, উহা অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাই স্মরণ করিয়া দিয়াছে। স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বৎসর পরও মুক্তিযোদ্ধাগণের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করিতে না পারিবার বিষয়টি নিঃসন্দেহে পরিতাপের। কিন্তু প্রতিবার সরকার পরিবর্তনের পর নূতন করিয়া তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ লইতে হয় কেন– উহাও কম বিস্ময়ের নহে। অতীতের ন্যায় এই দফাতেও আমাদের সংশয় কাটিতেছে না– মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় নূতন এই উদ্যোগের লক্ষ্য হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়নের কথা বলিলেও সেই লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জিত হইবে কিনা। কারণ ইহা লইয়া সপ্তম দফায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গৃহীত হইল। স্মরণে রহিয়াছে, অতীতের উদ্যোগগুলিতেও ‘বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য’ তালিকা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হইয়াছিল। কিন্তু কোনো তালিকাই শেষাবধি বিতর্কমুক্ত থাকে নাই। এই দফায় কি আমরা পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত তালিকা পাইব?
সর্বশেষ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নূতন করিয়া চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নকার্য শুরু করিয়াছিল। দীর্ঘ ‘যাচাই-বাছাই’ শেষে ২০২৩ সালের মার্চে চূড়ান্ত যেই তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়, তাহা লইয়া খোদ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই বিতর্ক উত্থাপিত হয়। প্রথমত, তালিকাটি প্রণয়নে দলীয় বিবেচনার প্রভাব ছিল ব্যাপক। দ্বিতীয়ত, বিশেষত উপজেলা পর্যায়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি বা কর্তনের সহিত অনেকাংশে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনও যুক্ত ছিল। উপরন্তু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৭ সহস্র জনের আপিল আবেদন অনিষ্পন্ন রাখিয়াই উক্ত চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। স্বভাবতই অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিজের নাম এ তালিকায় না দেখিয়াই পৃথিবী ত্যাগ করিয়াছেন। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করিয়াও তালিকাভুক্তির সমুদয় সুফল যে লভিয়া চলিয়াছে, কতিপয় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত হইবার মধ্য দিয়া উহা উপলব্ধ বটে। এখন গৃহদগ্ধ গরু সিঁদুরবর্ণ মেঘ দর্শনে ভীত হইবে না কেন?
আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান কতটা উচ্চে তাহা জানি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বিধায় তাহাদের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্য– এই বিষয়েও কোনো বিতর্ক নাই। তাই দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ১৯৭১ সালে যাহারা নির্দ্বিধায় জীবন উৎসর্গকরণের মানসিকতা লইয়া যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন, তাহাদের একটা নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কারণে নহে; স্বাধীন-সার্বভৌম, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ মুঠিতে ধারণ করিয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই কারণে এমনকি অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদ পর্যন্ত গ্রহণ করেন নাই। তবে ইতোমধ্যে রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাহার দায়িত্ব পালনের অংশরূপে অপর্যাপ্ত হইলেও কিছু সুযোগ-সুবিধা বরাদ্দ করিয়াছে। সেইগুলি যাহাতে প্রকৃত হস্তে পড়ে তজ্জন্যও প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন অপরিহার্য।
সন্দেহ নাই, নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃতই এই তালিকা প্রণয়নের যোগ্যতা রাখে। কিন্তু ‘সরকার’ কেবল উপদেষ্টামণ্ডলীতে সীমিত নহে; কেন্দ্র হইতে তৃণমূল অবধি বিস্তৃত আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেই সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু অতীতে খোদ আমলাগণের অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হইয়াছেন। এইবারও তদ্রূপ অনিয়ম না হইবার নিশ্চয়তা আমরা কীভাবে পাইতে পারি? অতীতে যদ্রূপ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে কাজ করিবার অভিযোগ রহিয়াছে, এইবারও উহার পুনরাবৃত্তি না হইবার কী কারণ থাকিতে পারে? উপরন্তু যেই সকল মুক্তিযোদ্ধা এখনও জীবিত, তাহাদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভাজন কম নহে। তালিকা প্রণয়নকালে এই সকল বিষয় সম্পর্কে সচেতনতার প্রতিফলন আমরা প্রত্যাশা করি। বিশেষত নূতন করিয়া যাচাই-বাছাইয়ের নামে শেষ বয়সে আসিয়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি হয়রানির শিকার হন, উহা অপেক্ষা অগ্রহণযোগ্য আর কী হইতে পারে!
- বিষয় :
- মুক্তিযোদ্ধা