স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশনা
ফলেন পরিচয়তে
প্রতীকী ছবি
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৭
কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করিতে ‘সাদা পোশাকে’ না যাইতে সোমবার যেই নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দিয়াছেন, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনায় পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সহিত মতবিনিময়কালে উপদেষ্টা এই নির্দেশনা প্রদান করেন। একই অনুষ্ঠানে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার না করিবারও নির্দেশনা দিয়াছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশনাসমূহ এমন সময়ে আসিল, যখন পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিনা পরোয়ানায় এবং সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার অভিযান চালাইবার অভিযোগ নূতন করিয়া উঠিতেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতিরেকেই গ্রেপ্তারের পর তাঁহার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অভিযোগও রহিয়াছে। এমনকি অভিযুক্তের জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়েও অনেকাংশে নিয়ম মান্য করা হইতেছে না। স্বাভাবিকভাবেই মানবাধিকার ও আইনের শাসনপ্রত্যাশী নাগরিকের মধ্যে এহেন পরিস্থিতি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করিয়াছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আলোচ্য নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হইলে উক্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হ্রাস পাইতে পারে বলিয়া আমরা মনে করি।
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাচারমূলক গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দিতে পারে না। বাংলাদেশ এই ঘোষণায় অনুস্বাক্ষরকারী অন্যতম দেশ। সেই ঘোষণার অনুসরণেই সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া এবং গ্রেপ্তারের পর তাহার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয় লইয়া স্পষ্ট নির্দেশনা লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সংবিধানের সেই সকল নির্দেশনা স্বাধীনতার পর হইতেই অমান্য হইয়া আসিতেছিল। ইহারই ফলস্বরূপ ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেল ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার হইবার পর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঐ ঘটনা লইয়া জনপরিসরে ব্যাপক প্রতিবাদ হইলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্তের পর কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কতিপয় সুপারিশ করে। উক্ত সুপারিশ উপেক্ষিত হইলে স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থা হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। যাহার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে আদালত উক্ত বিষয়ে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়া এক রায় দেন। সেই রায় উপযুক্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালে আপিল বিভাগও বহাল রাখেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের ঐ ১৫ দফা নির্দেশনা লঙ্ঘন করিয়াও বিশেষত প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের বিরুদ্ধে পুলিশের বিভিন্ন শাখা ও র্যাবকে লেলাইয়া দিবার প্রবণতা বন্ধ হয় নাই।
আমরা দেখিয়াছি, গত জুলাই-আগস্টে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ যে রাজপথে নামিয়া আসিয়াছিল, উহার অন্যতম কারণ দেশের নাগরিকদের এহেন মানবাধিকার খর্বের ঘটনাবলি। এই কারণেই সকলের প্রত্যাশা ছিল, ঐ স্বেচ্ছাচারী সরকারের বিদায়ের পর গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সকল প্রকার অপরাধ দমনে কঠোর হইলেও অন্তত এই ক্ষেত্রে সংবিধানস্বীকৃত বিধানাবলি মান্য করিয়া চলিবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা যে অদ্যাবধি অপূর্ণ রহিয়া গিয়াছে, তাহা ইতোমধ্যে বলা হইয়াছে। যেই কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকেও আলোচ্য নির্দেশনাসমূহ জারি করিতে হইয়াছে। যদিও আমরা বৃক্ষের পরিচয় ফলের মাধ্যমেই জানিতে চাহিব।
আমাদের বিশ্বাস, শুধু উপদেষ্টার নির্দেশনাই পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাইবে না। নির্দেশনাসমূহের প্রতিপালন নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণও আবশ্যক। সত্য, বর্তমান সরকারের কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত নাই। তাই বর্তমানে পুলিশকে অতীতের দলীয় সরকারগুলির ন্যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রশ্ন উঠিবার সুযোগ নাই। কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনের অধীনে গঠিত আমাদের পুলিশ বিভাগ অদ্যাবধি ঔপনিবেশিক আইন দ্বারাই পরিচালিত হইতেছে, যেই আইনে অন্যান্য বিষয়, তৎসহিত মানবাধিকারও স্থান পায় নাই। উপরন্তু প্রশিক্ষণকালে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্তত মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষা কতটা পায়– উহা লইয়াও প্রশ্ন বিস্তর। তাই সর্বোচ্চ মহল হইতে আলোচ্য নির্দেশনা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ব্যতীত প্রত্যাশিত ফলপ্রাপ্তি এক প্রকার অসম্ভব।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়