শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
বুদ্ধিবৃত্তির পরম্পরা রক্ষিত হউক
প্রতীকী ছবি
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৪
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর বেদনাবিধুর দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাহাদের এই দেশীয় দোসররা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এক ভয়ংকর বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করে। প্রতি বৎসর এই দিনে জাতি শোকাতুর হৃদয়ে সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলি স্মরণ করে। একই সঙ্গে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করিয়া থাকে পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রামে জাতির সেই সূর্যসন্তানদের মহৎ বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের কথা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতির চিন্তা ও মননচর্চায় নেতৃত্ব দানকারী মানুষদের উপর নিধনযজ্ঞ বস্তুত কালরাত্রিরূপে পরিচিত ১৯৭১ সালের সেই ২৫ মার্চ হইতেই চলিয়াছে। বিশেষত ঐ বৎসর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আসন্ন পরাজয় উপলব্ধি করিতে পারিয়া হানাদার বাহিনী রীতিমতো তালিকা ধরিয়া বুদ্ধিজীবী হত্যায় মত্ত হইয়া উঠে। বিশ্বের অপর কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ইহার তুলনা নাই বলিলেই চলে। এই কারণেই ১৪ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে একটা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হইয়া আছে। ১৯৭১ সালের এই বিশেষ কালপর্বে আমরা যে সকল বরেণ্য ব্যক্তিকে হারাইয়াছি, তাহাদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীনসহ কয়েক শত লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও সাংবাদিক তথা মননশীলতার চর্চাকারী। আজিকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সহিত তাহাদের সকলকে স্মরণ করি।
প্রতি বৎসরের ন্যায় এইবারও নিশ্চয় এই দিবসে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, তৎসহিত দেশের সর্বত্র বিভিন্ন সভায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও কর্ম লইয়া আলোচনা হইতেছে। আমাদের বিশ্বাস, এই সকল আলোচনায় সমগ্র জাতির উদ্দেশে নূতন এক শক্তিতে বলীয়ান হইবার বার্তা প্রেরণ করা হইতেছে। এই কথাটা বিশেষভাবে বলিবার কারণ এই, এইবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এমন এক পরিস্থিতিতে পালিত হইতেছে যখন গত ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া একটা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। এই সরকার সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করিতেছে। এই কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শহীদ বুদ্ধিজীবী সকলেই পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণবিরোধী সংগ্রামে বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করিয়াছেন। জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা সঞ্চারে তাহাদের ভূমিকা তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব অপেক্ষা কম ছিল না। বরং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবিতে সংঘটিত যে আন্দোলনকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি সৃষ্টির কৃতিত্ব প্রদান করা হয়, বাঙালি সমাজে সেই আন্দোলনের অবিনাশী শিখা তাহারাই প্রজ্বলিত করিয়াছিলেন। মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়া প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হইয়াছিল, তাহারও পটভূমি সৃষ্টিতে সেই বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল বিশাল। আজিকে যখন জাতি নূতন করিয়া সেই সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছে, উহা বাস্তবায়নেও বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখিতে হইবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সহিত আাজিকার বুদ্ধিজীবীদের একটা পরম্পরাগত সম্পর্ক রহিয়াছে। তাই পূর্বসূরিগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া জাতির বিভিন্ন সংকট ও প্রয়োজনে বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবীগণ ভূমিকা রাখিবেন– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা ইহাও মনে করি, কর্ম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীগণ আমাদের যতটা ঋণী করিয়া গিয়াছেন, তাহা পরিশোধে আজিকার বুদ্ধিজীবীদেরও ভূমিকা রাখিতে হইবে। উহারই অংশরূপে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়ন, তৎসহিত তাহাদের স্বজনদের দুর্দশাগ্রস্ত অংশকে যথাযথ পুনর্বাসনের নবতর উদ্যোগও লইতে হইবে। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারকার্যও দ্রুত সমাপ্ত করা প্রয়োজন।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়