ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সংস্কার ও নির্বাচন

কার্যকর ঐকমত্য কাম্য

কার্যকর ঐকমত্য কাম্য

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৩:২৭

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ২০২৫ সাল বাংলাদেশের জন্য কার্যকরী ঐকমত্য সৃষ্টির বৎসর হইবে বলিয়া যেই আশাবাদ ব্যক্ত করিয়াছেন, উহা কোনো প্রকারেই ব্যর্থ হইবার অবকাশ নাই বলিয়া আমরা মনে করি। ড. দেবপ্রিয় বুধবার সমকালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে, যিনি বাংলাদেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিরও প্রধান– স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছেন, বাংলাদেশের উত্তরণকে স্থিতি দিবার জন্যই এই কার্যকরী ঐকমত্য সৃষ্টির প্রয়োজন হইবে। 

সত্যিই ২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব বৎসর, যখন শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় দশকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন অপসৃত হয়। সেই সঙ্গে উক্ত অপশাসনের কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অরাজকতা নিরসনেরও বিরল এক সুযোগ উপস্থিত। উক্ত দীর্ঘ সময়ে জনগণ শুধু ভোটাধিকার হইতেই বঞ্চিত হয় নাই; সরকারি প্রশাসনের কেন্দ্র হইতে পরিধি অবধি সীমাহীন দলীয়করণ ও দুর্নীতির শিকার হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় এক প্রকার অলিগার্কি বা কতিপয়তন্ত্র, যাহার ভিত্তি ছিল শাসকদের স্বজনতোষণ। ইহার প্রভাবে একদিকে বিশেষত ব্যাংকিং খাতে একের পর এক প্রতিকারহীন আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটিয়াছে, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি জনজীবনে লইয়া আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। এখনই সময় জনগণের উদ্দেশে এই সকল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা হইতে নিষ্কৃতির পথ বিষয়ে বার্তা দিবার। এই বার্তা যাইতে হইবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে যাহারা বর্তমানে আছেন এবং যাহারা ভবিষ্যতে একই দায়িত্ব পালন করিবেন তাহাদের সকলের সম্মিলিত অভিব্যক্তিরূপে। কিন্তু দুঃখজনক, বিদ্যমান বাস্তবতা এই বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করিতেছে না।

আমরা জানি, রাষ্ট্র মেরামতের বহুল উচ্চারিত ও সর্বব্যাপী প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গত আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াই অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করিয়াছে, যেগুলির সুপারিশমালা এই মাসের অর্ধাংশের মধ্যে জমা পড়িবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠিয়াছে– এই সকল সুপারিশ কখন, কাহারা বাস্তবায়ন করিবে। অনেকের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র সংস্কারের সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারকেই কার্যকর করিতে হইবে। আবার অনেকে মনে করেন, শুধু নির্বাচন-সংক্রান্ত বিধিবিধান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলি কার্যকর করিয়া অন্তর্বর্তী সরকার অবশিষ্ট সুপারিশমালা উত্তরসূরি নির্বাচিত সরকারের জন্য জমা রাখুক। শেষোক্ত ধারার মানুষ সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে জাতীয় নির্বাচনও প্রত্যাশা করেন। উপরের দুই ধারার ব্যবস্থাপনা তথা সংস্কারের কোনটা প্রাধান্য পাইবে, অবিলম্বে তাহা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ সরকারি প্রক্রিয়ার সংস্কার অপেক্ষা এই মুহূর্তে কাঠামোগত সংস্কারে বেশি ব্যাপৃত; যাহার ফলস্বরূপ মূল্যস্ফীতি বা নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি বিষয়ে হয়তো কম নজর পড়িতেছে। ইহাতে জনগণকে স্বস্তি জোগাইবার কার্যটিও অনেকাংশে অবহেলিত থাকিতেছে। তিনি যথার্থই বলিয়াছেন, নির্বাহী আদেশবলে এইগুলি করিলে পরবর্তী সময়ে সংসদের মাধ্যমে বৈধতা দিতে হইবে। এই প্রক্রিয়া আগাইয়া লইতে হইলে রাজনৈতিক দলগুলির সম্মতি লাগিবে এবং তাহাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে উক্ত সুপারিশমালা থাকিতে হইবে। তাহার এই আশঙ্কাও যথার্থ– এই বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হইলে অন্যান্য সংস্কার বিশেষত সামষ্টিক অর্থনীতি এবং বিভিন্ন খাতওয়ারি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ভেস্তে যাইতে পারে। একই সঙ্গে যাহারা বিধিবিধান এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলি করিতেছেন, তাহারা ভীত না হইলেও সংকুচিত হইয়া যাইতে পারেন। কারণ তাহারাও এক ধরনের ‘কথিত বৈধতার শূন্যতা’র মধ্যে কার্য চালাইতেছেন। 

প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হইলেও, ইহার প্রস্তুতি বস্তুত ২০২৫ সালেই শুরু করিতে হইবে। ফলে বর্তমান সরকারের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জের জায়গা হইল সংস্কার এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া যেই সকল পদক্ষেপ গৃহীত হইবে, সেইগুলির পক্ষে ন্যূনতম কার্যকরী জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা।

ড. দেবপ্রিয়র ন্যায় আমরাও মনে করি, ঐকমত্য সর্বজনীন হইতে হইবে, এমন নহে। কার্যকরী ঐকমত্য হইল মূল বা নিয়ামক অংশীজনের মধ্যে সমঝোতা। প্রত্যাশা, সরকার সেই লক্ষ্যে অবিলম্বে কার্যের সূচনা করিবে। 
 

আরও পড়ুন

×