ডেঙ্গুর হটস্পট বরগুনা
কর্মকর্তাদের নিদ্রামগ্ন থাকিবার ফল

প্রতীকি ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫ | ০০:৩৪
যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গৃহীত না হইলে একটা আশঙ্কা কতখানি দুঃসহ বাস্তবতায় পরিণত হয়, তাহার ধ্রুপদি উদাহরণ হইতে পারে বরগুনা জেলার প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর হটস্পট হইয়া উঠা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব উদ্ধৃত করিয়া শুক্রবার সমকাল জানাইয়াছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সমগ্র দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৫ সহস্র অপেক্ষা কিছু কম। তন্মধ্যে বরগুনাতেই ছিল প্রায় দেড় সহস্র, যাহা মোট রোগীর ২৫ শতাংশেরও অধিক। একই সময়ে বরিশাল বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে সোয়া দুই সহস্রাধিক, যাহার অর্ধেকেরও অধিক ছিল বরগুনায়। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, বরগুনায় বৃহস্পতিবার অবধি পাঁচজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটিলেও বাসাবাড়ি ও জেলার বাহিরে চিকিৎসা গ্রহণ করিতে গিয়া তথাকার অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হইয়াছে। এহেন পরিস্থিতিতে জেলায় চিকিৎসা সংকট প্রকট রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। বহু সংখ্যক রোগী বরগুনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে অবস্থান করিয়াও পর্যাপ্ত ঔষধ ও স্যালাইন না পাইবার অভিযোগ করিয়াছেন সমকাল প্রতিবেদকের নিকট। অন্যদিকে, ১০ জুনের বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের অঞ্চলভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়াছে, জেলার অন্তত ১৩ শত ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে সদরের গৌরীচন্না ইউনিয়নের বাসিন্দা ৩১৫ জন, দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামের রহিয়াছেন ১০৫ জন। পৌর শহরের নিকটবর্তী উক্ত অঞ্চল খুবই ঘনবসতিপূর্ণ, যেথায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দিষ্ট কোনো কার্যক্রম নাই। অসংখ্য ডোবা-নালা জলাবদ্ধ থাকে বেশির ভাগ সময়। অর্থাৎ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হইলে শুধু বরগুনার ডেঙ্গু পরিস্থিতিই অধিকতর জটিল রূপ ধারণ করিবে না; সংক্রামক রোগ বিধায় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও তাহা সম্প্রসারিত হইতে পারে। এমনকি রাজধানীসহ বৃহৎ শহরগুলিও যে এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ নহে, তাহা বলা বাহুল্য।
এমন নহে যে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে সতর্ক করা হয় নাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলিয়াছেন, বরগুনার ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হইবে– ইহা জানুয়ারিতেই অবহিত করা হইয়াছিল। বহু পূর্বেই জেলাটিতে ডেঙ্গু রোগী ছিল। তৎসহিত ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশার লার্ভা ও ঘনত্ব বেশি থাকায় হঠাৎ প্রকোপ বৃদ্ধি পাইয়াছে। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার বলিয়াছেন, সাধারণত শহরাঞ্চলে ঘরোয়া মশা এবং গ্রামে থাকে জঙ্গলের মশার উপস্থিতি। জানুয়ারির মশা জরিপে বরগুনায় দুই ধরনের মশার উপস্থিতি মিলিয়াছিল। এমন পরিস্থিতির কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে। সেই সময় জরিপের বিষয়টি তাহারা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা করিয়াছিলেন। কিন্তু সকল কিছু অবগত হইবার পরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই সংশ্লিষ্টরা। শুধু উহা নহে, দেশে নূতন কোনো ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। অথচ অদ্যাবধি বরগুনা হইতে কোনো নমুনাই সংগ্রহ করে নাই সংস্থাটি। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম বলিয়াছেন, তাহারা রোগীর নমুনা ঢাকায় পাঠাইতে বরগুনায় চিঠি দিয়াছেন।
ইতোপূর্বে আমরাও একাধিক সম্পাদকীয় স্তম্ভে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শিথিল সরকারি কার্যক্রম লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলাম। বিশেষত ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারির উদাহরণ টানিয়া উহার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করা হইয়াছিল, যখন সরকারি হিসাবেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লক্ষ অতিক্রম করিয়াছিল, আর মৃত্যু ঘটিয়াছিল ১৭৯ জনের। ২০২২ সালে প্রাণঘাতী এই রোগে মৃত্যু ছিল ২৮১, এবং উহার প্রধান কারণ ছিল সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলির উদাসীনতা– এই কথাও আমরা তখন স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলাম। বাস্তবে ঐ সকলই অরণ্যে রোদন বলিয়া প্রমাণিত হইতে চলিয়াছে।
আমাদের প্রত্যাশা, এহেন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি হইতে পরিত্রাণে দ্রুত স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই নিদ্রাভঙ্গ ঘটিবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রশমন, তৎসহিত সকলের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হইবে।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়