ঢাকা শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও একজন শিল্পী

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও একজন শিল্পী

ড. কাজী ছাইদুল হালিম

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ০২:০৮ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ০২:০৮

কালো মেয়ে, আবার মেয়ে। এ কথাগুলো আমাদের সমাজে শহরাঞ্চলে ততটা না শোনা গেলেও গ্রামাঞ্চলে হরহামেশাই শোনা যায়। পরপর একাধিক কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে কত মাকেই-না স্বামী এবং তার শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। মেয়েরা তার নিজের বাড়িতে, একান্ত আপন গণ্ডিতে প্রথমে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ক্রমে ক্রমে এই বৈষম্য পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয় তার আবাসিক এলাকায়, শিক্ষাঙ্গনে ও কর্মক্ষেত্রে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী।

এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নারীরা দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়ন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। তবুও এটা বাস্তব যে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা বিভিন্নভাবে এখনও নিগৃহীত হচ্ছে। এই নিগ্রহের অনেক কারণ আছে। তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একটা অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজ পুরুষ এবং নারীকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে থাকে। সেটা পরিবার, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র বা বৃহৎ সামাজিক পরিসর যা-ই হোক না কেন।

পরিবারে সাধারণত কন্যাসন্তানের লালনপালনে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমরা দেখি তা পুত্রসন্তানের লালনপালনে একেবারেই অনুপস্থিত। আর এজন্যই হয়তোবা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং নারীর নিরাপত্তাহীনতা একটা ক্রনিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। একটা কন্যাসন্তানকে অনেক ছোট থেকেই শুনতে হয় এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, সেখানে যাওয়া যাবে না, এমনভাবে কথা বলা যাবে না, অমনভাবে কাপড় পরা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক ছোট থেকেই 'না' শব্দটা যেন একটা মেয়ের জীবনের সঙ্গে ভীষণভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্যপক্ষে একটা পুত্রসন্তানকে কিন্তু এমন কিছুই শুনতে হয় না পরিবার কিংবা তার চার পাশের অন্য কারও কাছ থেকে। অধিকন্তু, অনেক সময় এ-ও বলতে শোনা যায় যে ছেলেরা এমন কিছু বলতেই বা করতেই পারে।

অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হয় যে, কন্যাসন্তানদের তাদের জীবন এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অতি শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে আর অন্যদিকে পুত্রসন্তান বা পুরুষদের জীবন এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে একেবারেই অশিক্ষিত করে রাখা হচ্ছে। এভাবেই সূত্রপাত হয় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং নিরাপত্তাহীন অবস্থার। সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। মেয়েদের মতো পুত্রসন্তানদেরও নারীর প্রতি আচরণ সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর এভাবেই নারী-পুরুষের সহাবস্থান নিশ্চিত হবে ঘরে, ঘরের বাইরে, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজের বৃহৎ পরিসরে।

আমাদের সমাজটা ভীষণভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছেলেদের পেশিশক্তি বা ক্ষমতার উৎস হিসেবে গণ্য করে। আর তাদের কাছে এজন্যই হয়তোবা মেয়েরা দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। মেয়েদের উন্নতিতে তারা ঈর্ষান্বিত হয়, পান থেকে চুন খসলে দোষটা মেয়েদেরই। তারা কখনোই স্বীকার করতে চান না আমরা দোষে-গুণে মানুষ। বহুল আলোচিত চিত্রনায়িকা পরিমণি দোষী কি নির্দোষ এ প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, তা মাননীয় বিচারকরা দেখবেন। তবে পরিস্থিতি দেখে যে কোনো মানুষের এটা অতি স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে যে আটাশ বছর বয়সী অভিভাবকহীন একটি মেয়ে বিচারের আগেই কি এতটা শাস্তির যোগ্য ছিল! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা বিশাল বহর নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়! অবিশ্বাস্য আয়োজন!

এমনটা কি হতে পারত না, পরীমণির বিরুদ্ধে যদি কোনো অপরাধের অভিযোগ থেকেই থাকত তাহলে থানা পুলিশের কোনো একজন কর্মকর্তা একটা সংক্ষিপ্ত ফোনে তাকে থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে গ্রেপ্তার করতেন। দুঃখজনক হলেও তা হয়নি। বোট ক্লাবের ঘটনার পর থেকে তদন্ত সংক্রান্ত কাজে পরীমণির সঙ্গে এমনিতেই পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এরপরও কেন এই বিশাল বাহিনী নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল মশা মারতে কামান দাগানোর আয়োজন।

মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক পরীমণির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফা রিমান্ডের আদেশের ব্যাখ্যা চাওয়া সংশ্নিষ্ট বিচারক ও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যথার্থ এবং সময়োপযোগী বলা যেতে পারে। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের অভ্যন্তরে পরীমণিকে তিনবার রিমান্ডে নিতে চাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে তদন্ত করে অন্য কোনো রহস্য ছিল কিনা তা দেখা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে আগামীতে রিমান্ডের চাওয়ার সময় যত কমানো যায় ততই ভালো অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য এবং সরকারের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের নিমিত্তে।

আমরা যখন ব্যক্তি পরীমণির দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই, তার এতদূর উঠে আসার পথটা কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। মাদক গ্রহণ এবং মাদক রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা কর্তৃক পরীমণিকে 'রাতের রানী' বলে কটূক্তি করা একজন কর্মকর্তার পদ- পদবি এবং শিক্ষার সঙ্গে বড়ই বেমানান। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগামীতে শব্দ চয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।

পরীমণি একজন অভিনয় শিল্পী। শিল্পীর শিল্পসত্তা যতটা না অর্জিত, এর চেয়েও বেশি প্রদত্ত। এই শিল্পীরাই কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের সুস্থ বিনোদন জগৎ তৈরির ভবিষ্যৎ। তারা অনেক কিছু না পেয়েও অগণিত মানুষের বিনোদনের খোরাক জোগান। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও বিনোদন জগতের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। বিনোদন জগতের প্রতিটা সদস্য যেন নিরাপত্তার সঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা নিয়ে সুস্থ অভিনয়কর্ম চালিয়ে যেতে পারেন তার প্রত্যাশা। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। পরিবার থেকেই ছেলে এবং মেয়েশিশুদের সমানভাবে সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হোক। তবেই ভবিষ্যতে নিশ্চিত হবে নারী-পুরুষের নির্ভয় সহাবস্থান। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের দেশ হিসেবে।

 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×