ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

স্মরণ

একজন সমাজসচেতন কথাশিল্পী

একজন সমাজসচেতন কথাশিল্পী

নাজমা জেসমিন চৌধুরী

নাসির উদ্দীন ইউসুফ

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩:০৫

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর প্রয়াণের আড়াই যুগ অতিক্রান্ত হলো। ৩২ বছর অতিক্রান্ত হলেও তার জায়গায় কেউ তো দাঁড়াল না। সে অভাব থেকেই গেল। আমরা তখন ছুটছি তীব্রগতিতে সদ্য স্বাধীন দেশে। জীর্ণ-পুরোনোকে ছুড়ে ফেলে নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে। নতুন কিছু করা চাই। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্পকলা- সর্বক্ষেত্রে এক নবউত্থানের সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি হঠাৎ ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হলো। এর মধ্যে '৭৫-এর মধ্য আগস্টে সংঘটিত রক্তাক্ত অধ্যায় এবং সামরিক শাসন দেশকে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করল। তারপরও নাটক-কবিতা-চিত্রকলা-উপন্যাস; অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে শিল্পকলা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া গণমানুষের রায় এবং স্বপ্টম্ন নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখল। এই যাত্রাপথে আমরা আবার সাক্ষাৎ পেলাম নাজমা জেসমিন চৌধুরীর। অন্য এক নাজমা আপা। সদাহাস্য, বিনয়ী মানুষ। সংগঠক ও সৃষ্টিশীল একজন মানুষ।

১৯৭৬ সালে ঢাকা থিয়েটার সিদ্ধান্ত নেয় শিশু-কিশোরদের নাট্যদল গড়ার। বেগম মমতাজ হোসেনসহ কয়েক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে মুস্তাফা মজিদ নাট্যদল 'ঢাকা শিশুনাট্যম' সংগঠিত করে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করলেন। কবি হাবিবুর রহমান রচিত 'আলোর ফুল' এবং 'মায়াকানন' নাটক দুটি মঞ্চায়নের পর অরুণ চৌধুরীর নাট্যরূপে সুকুমার রায়ের হযবরল তৃতীয় প্রযোজনা। নাজমা আপা হযবরল নাটক দেখতে এসে আমাদের নাট্য-আন্দোলনে জড়িয়ে গেলেন। যদিও এর মধ্যে নাজমা আপা বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জাতীয়ভিত্তিক নাট্য রচনা প্রতিযোগিতায় তার রচিত নাটক প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। কিন্তু টেলিভিশন নয়, মঞ্চই হচ্ছে নাটকের মূল ভূমি- এ ধারণা তার বিশ্বাসের অন্তর্গত। তিনি মঞ্চের জন্যই প্রথম নাটক লিখলেন ১৯৭৮ সালে 'আলোটা জ্বালো'; মঞ্চায়ন করল ঢাকা শিশুনাট্যম। নির্দেশনায় ছিলেন মুস্তাফা মজিদ। ১৯৭৮ সালেই তিনি সংগঠিত করলেন ঢাকা লিটল থিয়েটার। মযহারুল ইসলাম বাবলা ও মোরশেদুল ইসলাম ঢাকা লিটল থিয়েটার সংগঠনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঢাকা লিটল থিয়েটারে যে নাজমা আপাকে পেলাম, তিনি এক ভিন্ন মানুষ। শিক্ষক নন, বন্ধু সবার; বন্ধু ছোট-বড় সবারই। আমাদের লিটল থিয়েটারের মহড়া শুরু হতো তার বসার ঘরে এবং ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ত বারান্দা হয়ে শোয়ার ঘর পর্যন্ত। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার নীরবে বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে হাঁটতে চলে যেতেন; যেন আমাদের অসুবিধা না হয়। নাজমা আপা মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন নাট্যকার হিসেবে, আবার এক ফাঁকে দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে চা-নাশতা বানাতেন। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা খাওয়া। সব এক হাতে করতেন।

ঢাকা লিটল থিয়েটারের প্রথম নাটক কী হবে, কে লিখবেন? সবাই বললাম, 'নাজমা আপা, আপনি লিখুন।' তিনি স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, 'আমি পারব?' সবার চাপাচাপিতে রাজি হলেন। রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেশ' ছোটদের জন্য রূপান্তরের কাজে হাত দিলেন। মযহারুল ইসলাম বাবলা ও মোরশেদুল ইসলাম যৌথভাবে নির্দেশনা দিলেন 'তাসের দেশ' নাটকটি। আশাতীত সাফল্য ও সাড়া পেল নাটকটি। এ ছাড়াও শিশুদের জন্য নাটক লিখেছেন বেশ ক'টি : আলোটা জ্বালো (ঘুম নেই), অন্য রকম অভিযান, যেমন খুশি সাজো, ওরা ছিল বাগানে, হিংসুটে দৈত্য ইত্যাদি। নাটকের পাশাপাশি ছোটদের জন্য উপন্যাস লিখেছেন 'শেষ ঠিকানা', 'আমার খোকা যায়', 'ভোর হয়-রাত হয়'। শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস 'সংশপ্তক' রূপান্তর করেছেন ছোটদের জন্য 'কিশোর সংশপ্তক', রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেশ।' ছোটদের জন্য গল্পও লিখেছেন 'বাড়ি থেকে পালিয়ে', 'জিতল কারা', 'ভয়ের আড়ালে।' শিশুতোষ লেখার পাশাপাশি বড়দের জন্য লিখেছেন উপন্যাস 'সামনে সময়', 'ঘরের ছায়া', 'লোকে বলে' এবং বেশ ক'টি ছোটগল্প :'অন্য নায়ক', 'মেঘ কেটে গেলে', 'নানা রঙে বোনা', 'মাছ', 'তোমাকে অভিনন্দন দীপা।' নাটক, 'আলোয় ফেরা।' বিটিভিতে প্রচারিত নাটক- খেলা, ছাড়পত্র, পালাবদলের পালা, প্রথম অঙ্গীকার, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রিয়জন, ঘরের ছায়া। গবেষণা ও প্রবন্ধ 'বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি'। গ্রন্থটি কলকাতা থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। 'সাহিত্যে সামাজিকতা' (বাংলা একাডেমি)। সম্পাদিত গ্রন্থ মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলি (বাংলা একাডেমি)। নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখা ঋজু কাঠামোর গল্প-উপন্যাসের প্রধান সব চরিত্র নারী এবং প্রতিবাদী। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন তার সৃষ্টিশীল মুখরতায় বাঙ্‌ময় হয়ে ওঠে, জ্বলে ওঠে। নাজমা জেসমিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গল্প 'তোমাকে অভিনন্দন দীপা' পড়ে চমকে উঠতে হয়। তিনি শিশুতোষ লেখক বা একজন ঔপন্যাসিকই নন; একজন মুক্ত ও স্বাধীন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনীতিসচেতন কথাশিল্পী। না, শুধু এ গল্পেই নয়; তার বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, নাটকে মুক্তির কথা এসেছে ঘুরেফিরে।

ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ভীষণ স্নেহ ও পছন্দ করতেন। আমাকে একদিন বলেছিলেন, 'বাচ্চু, তুমি যত বড় নাট্য নির্দেশক হও না কেন, আমার কাছে তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয় তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।' শুনে আমি চমকে উঠেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার চেতনার গভীরতায় বিস্মিত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে নানা জায়গা বদল করে স্যারকে আগলে রেখেছিলেন তিনিই। তাই আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যারকে ঘাতক আলবদর বাহিনীর শিকারে পরিণত হতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে অনেক বড় কাজ করবেন। এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু সময় পেলেন না। ঘাতক ব্যাধি তাকে অকালে কেড়ে নিল। নাজমা জেসমিন চৌধুরীর অকালপ্রয়াণ আমাদের বঞ্চিত করেছে একজন কথাশিল্পীর কালোত্তীর্ণ সাহিত্য থেকে। সমাজ বঞ্চিত হয়েছে একজন সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন শিল্পীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও সৃষ্টি থেকে। নাজমা জেসমিন চৌধুরীকে শুধু এক ব্যক্তির পরিমাপে দেখলে চলবে না। তাকে দেখতে হবে সমষ্টির আঙ্গিকে। বুঝতে হবে সমাজ বাস্তবতা এবং বিপরীত বাস্তবতার জমিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্টেম্নর গান, যা তিনি রচনা করেছিলেন। এটুকু বোঝার জন্যই আমার এ অসম্পূর্ণ রচনা।

নাট্যজন ও চলচ্চিত্রকার

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×